লক্ষ্মীপুরের তাহের ও তাঁর প্রতিভা! by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

লক্ষ্মীপুরের সন্ত্রাসী তাহের_খুন, হত্যা, লুটপাট ও চাঁদাবাজির নানা রকম ঘটনার পর সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাঁর ছেলে বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করিয়ে নেওয়ার পর তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছি। তাহের আর তাঁর সন্ত্রাসী ছেলে বিপ্লব আমাদের নষ্ট সমাজের নায়ক হয়ে উঠেছেন পত্রিকাগুলোতে, এক মাস ধরে।


লক্ষ্মীপুরের এই দুই মহারথী কর্তৃক ঘটে যাওয়া খুন, ধর্ষণ আর গুমের ঘটনা জানার জন্য ব্যগ্র আজ বাংলাদেশের সাংবাদিক থেকে মসজিদের ইমাম_সবাই! রাষ্ট্রপতির মহানুভবতায় (?) খুনের মামলাগুলো থেকে খালাস পাওয়ার পর বিপ্লবকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছি। কারণ তিনিই এখন আমাদের সময়ের নায়ক (যদিও কেউ কেউ বলছেন খলনায়ক)! আগের দিনে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের উপন্যাসগুলোতে সত্যবাদী, পবিত্র আর মহৎ মানুষরা নায়কের জায়গা দখল করেছেন। বিপ্লবের ফাঁসি মওকুফ হয়ে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে সেই দিনের এখন অনেক বদল ঘটেছে। সেই জায়গা এখন দখল করে নিয়েছেন বিপ্লবের মতো বদমাশরা। সমাজ, রাষ্ট্র আর সভ্যতার ব্যবস্থাপক হয়ে উঠেছেন তাহের আর বিপ্লবরা। টাকা, রক্ষিতা, মাদকদ্রব্য, চোরাচালান, অবৈধ ব্যবসা, বিরোধী দল এবং নিজ দলের নেতাদের খুনের মতো কাজগুলো তাঁরা করছেন নির্বিঘ্নে।
লক্ষ্মীপুরের তাহের আর তাঁর ছেলে বিপ্লবের সবচেয়ে বড় প্রতিভা হচ্ছে, তাঁরা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা। মনে হয়, এই একটি পরিচয়ের সুবাদে তাঁরা বাংলাদেশে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ_সব কিছু করার অধিকার রাখেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, চার-পাঁচটি খুনের মামলা থাকার পরও বিপ্লবের শাস্তি হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাওয়ার পর ইচ্ছা হচ্ছে, বিপ্লবের কাছে গিয়ে বলি_'আপনিই আমাদের নায়ক, আপনার প্রতিভা আর ক্ষমতায় মুগ্ধ আমরা, খুন করে আপনি ধন্য করুন আমাদের!'
পত্রপত্রিকা থেকে লক্ষ্মীপুরের তাহের সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তাতে এতটুকু বুঝতে পারি, লক্ষ্মীপুর শহরে এক আতঙ্কের নাম আবু তাহের। তাঁর আর তাঁর ছেলে বিপ্লবের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। হত্যা, চাঁদাবাজি, দখল, ধর্ষণ, লুটপাট, সংখ্যালঘু নির্যাতন_অপরাধের যত শাখা আছে, সব কটিতেই তাহের আর তাঁর ছেলেদের সমান বিচরণ। লক্ষ্মীপুর সদর এবং এর আশপাশের তিন-চারটি ইউনিয়নে আগের বারের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে ধর্ষণের ঘটনাগুলো ঘটেছিল, তার প্রায় সবটাতেই তাহের বাহিনী কোনো না কোনোভাবে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তাহের আর তাঁর ছেলে বিপ্লবের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের হুমকি ও নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগ তো আছেই। এতটা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হওয়া সত্ত্বেও এই ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবকে লালন করে চলেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ বুঝতেও পারছে না, সন্ত্রাসী বিপ্লবকে ক্ষমার ব্যাপারটি জনগণ ভালোভাবে নেয়নি।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আছে, যে কাউকে তিনি ফাঁসি থেকে মুক্তি দিতে পারেন। কিন্তু বিপ্লবের ক্ষেত্রে তিনি শুধু মুক্তিই দেননি, বরং আসামিকে খালাস করে দিয়েছেন। ফাঁসি মওকুফ করে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিপ্লবকে ফাঁসির আসামি হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমা করে দেওয়ায় দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আজ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি সরকারের আমলেও একই সংস্কৃতি অনুসরণ করা হয়েছিল। তারাও রাজনৈতিক বিবেচনায় ঝিন্টুর প্রাণদণ্ড মওকুফ করেছিল। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি_যে দলই হোক না কেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় এ রকম প্রাণদণ্ড মওকুফের ঘটনা যদি ধারাবাহিকভাবে চলতে দেওয়া হয়, তাহলে দেশজুড়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা বাংলাদেশে কোনো দিনও সম্ভব হবে না। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় যদি অপরাধীর অপরাধ মাফ করে দেওয়া হয়, তাহলে বোঝা যায়, রাজনীতি কতটা সীমা লঙ্ঘন করছে বাংলাদেশে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের চলতে দেওয়া উচিত কি না?
মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। অন্ধকার এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। যে রাজনীতি ন্যায়বিচারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করে, সে রাজনীতি কতটা সহায়ক একটি দেশের জন্য? সমস্যা হচ্ছে আমাদের রাজনীতি নিয়ে। আমাদের দেশের রাজনীতি পৃষ্ঠপোষকতা করে টাকার, মাস্তানির, অস্ত্রের। বিপ্লবকে যেখানে চিহ্নিত করা দরকার ছিল একজন খুনি হিসেবে, সেখানে তাকে বিবেচনা করা হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে। এই বিবেচনাটাই আগামী দিনগুলোতে বিপ্লবদের ঔদ্ধত্য আরো বাড়িয়ে দেবে। আর বিপ্লবরা খুন করে যাবে নিষ্পাপ বাংলাদেশকে।

লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া
shahnewaybiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.