লড়াই গেছে থেমে-শ্রীলংকা by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

গৃহযুদ্ধের অবসান হয়ে শান্তির পরিবেশ ফিরে আসতে চলেছে জাফনায়। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করতে গিয়ে জানালেন রোটারি কনফারেন্সে আসা দুইশ' অভ্যাগতকে ৪ সেপ্টেম্বর প্রাসাদোপম সিনামন হোটেলের সুসজ্জিত কক্ষে : বন্ধুরা, লড়াই গেছে থেমে।
যথাসাধ্য চেষ্টা করছি শান্তিকে সুরক্ষিত করতে। প্রচেষ্টা দক্ষিণ এশিয়ায় এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যেখানে আলাদা থেকেও মিলিত হতে পারি খোলামন, খোলা ব্যবসা-বাণিজ্য, খোলা সম্প্রীতি নিয়ে। 'দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে।' বৃহৎ কনফারেন্স, প্রতি বক্তৃতা, মঞ্চসজ্জা, খাদ্য, সংস্কৃতিসন্ধ্যা নির্মিত সুনিপুণভাবে, যেমনটি শ্রীলংকার শহর-বন্দর রাস্তাঘাট, সমুদ্রসৈকতে।
প্রথমবারের মতো গিয়ে বিস্মিত ও হতবাক। মানুষ শিক্ষিত, নিয়ম মেনে চলে, বুদ্ধ অথবা শিব কিংবা আল্লাহ_ কারও সামনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মন নিয়ে প্রণতিরত। এটুকু হলেই জাতি নির্মাণ সম্ভব। এক লাখ পঁচিশ হাজার বছরের ইতিহাস পেছনে, সামনে দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধতম জাতি হিসেবে এগিয়ে চলার প্রত্যয়। সংবাদপত্রের পাতা খুললেই সম্ভাবনার খবর। নতুন রাস্তা, নতুন রেল, নতুন হোটেল। খেটে খাওয়া মানুষের খুশি হওয়ার মতো ঘটনা। দু'তিনটি ইংরেজি কাগজ পড়ার সুযোগ পেলাম সাত দিন ধরে। মন ভরে যাওয়ার মতো খবর, যেমনটি মন ভরে যায় শত শত ট্যুরিস্ট রিসোর্টের সম্ভারে সমুদ্র খেলা অপরূপ প্রকৃতির বিস্তারে। ইউরোপ থেকে প্লেনবোঝাই মানুষ ছুটে আসছে নভেম্বর থেকে এপ্রিলে। এক কোটি নব্বই লাখ মানুষের দেশে উপস্থিত পাঁচ লাখ ট্যুরিস্ট, সম্মুখে তাদের অবারিত সমুদ্র গর্জন। নেই অন্য কোনো শব্দ, অন্য কোনো কোলাহল, নারিকেল সুশোভিত প্রাচীন সমুদ্র বিভাষিত সিংহল দ্বীপে।
প্রথম রাতের ব্যাংকোয়েটে দেরি করে ঢুকেছি। কারণ 'মাহিন লংকা' পেঁৗছেছে তিন ঘণ্টা দেরিতে। এর মধ্যেই পরিচয় হলো কিশোর, কৈশিক ও ভানাতির সঙ্গে। পাশেই দাঁড়িয়ে দীনেশ গান্ধী ও দুলিতা। ঢাকা থেকে গেছেন মন্ত্রী শারমীনের সঙ্গে শাহরিন ও পাকিস্তান থেকে আজিজ মেনন। ডিরেক্টর ওপি ভয়েস-মঞ্জু, প্রেসিডেন্ট কল্যাণ ব্যানার্জি-বিনতা ব্যানার্জি। পাস্ট আর আই প্রেসিডেন্ট রাজা সাবু বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তেমনি পিডিজি পুনম-মনপ্রীত। তারা আমাদের পুরনো বন্ধু। অনেক দিন পরে দেখা নেপাল থেকে আগতা সুন্দরী দরিদ্র বন্ধু : জয়ারাজ্য লকসমিসার সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে এসেছেন পিডিজি আমিনুজ্জামান ভূঁইয়া, এমএ আউয়াল, আনিস, রফিক সিদ্দিকী, গোলাম মোস্তফা, সফিনা রহমান, শ্রাবণী সরকার ও অনেকে। রোটারি ডিরেক্টর রবীন্দ্রাম ও ইমরান প্রতিক্ষণ খোঁজ নিচ্ছেন ভালো-মন্দের। চেন্নাই ও ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে এসেছেন আশিজন রোটারি নেতা। তাদের মধ্যে আমাদের পুরনো বন্ধু ডিরেক্টর পান্ডুরাঙ্গা শেথি। পাকিস্তান থেকে পঁচিশজন, বাংলাদেশ থেকে পঁচিশজন। বক্তৃতা মঞ্চে হাসান শাহরিয়ার, সার্ক চেম্বারের সভাপতি আনিসুল হক ও সম্পাদক জগলুল হায়দার।
কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাসান শাহরিয়ার বললেন, এর আগেও এ রকম কনফারেন্স হয়েছে। সার্কেরও বয়স কম হলো না। কিছুই এগোচ্ছে না। লেখালেখি করে কোনো লাভ নেই। ফলোআপ করার কেউ নেই। সার্ক করে লাভ হয়নি। মনের মধ্যেই তালা। আমি বললাম, 'ক্লোজড সার্কিটে' অর্থাৎ গোলটেবিলে : মনের মধ্যে কালিমা লুকিয়ে, দূর করবে কে। চৌধুরী সাজলে কেউ মানবে কি? গান্ধীকে হত্যা করি, মুজিবকে হত্যা করি, রাজীব-বেনজির-জিয়া কাউকেই ছেড়ে দিই না। ভিসার জন্য গলবস্ত্র হতে হয়। একশ'জনকে সার্ক ভিসা দেওয়া হয়েছে, শোনা গেল বাড়িয়ে করা হবে পাঁচশ'জন। ক্ষুদ্র লেখক হিসেবে হয়তো দরখাস্ত করতে পারব। ভারতে যেতে চাইলে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে। কনফারেন্সে বড় বড় সাজেশন। নাম দেওয়া হলো : 'কলম্বো ডিক্লারেশন'। ছাপা হয়ে বই হয়ে বেরোবে। এর আগেও চারটি কনফারেন্স হয়েছে। দুটি দিলি্লতে, দুটি ঢাকায়। ফলাফল শূন্য। মাহিন্দ রাজাপাসকে ব্যাপারটি সহজ করে দিয়েছেন। আটটি দেশের যে কেউ গেলে এয়ারপোর্টেই ভিসা দেওয়া হবে। আমি পেয়েছি ত্রিশ সেকেন্ডে। জয় হোক মাহিন্দের।
কোচবিহারে গ্রামের বাড়ির সামনে হাতি বাঁধা। গরু, মহিষ, হরিণ। কে আর বিশ্বাস করবে। হাতি দেখতে এলাম শ্রীলংকায়। ক্যান্ডির কাছে হাতির অভয়ারণ্যে শত শত হাতি দেখে নয়ন সার্থক। ট্যুরিস্টরা এসেছেন দলবেঁধে। তারা নাম দিয়েছেন : 'এলিফ্যান্ট অরফানেজ'_ হস্তী এতিমখানা। হোটেল ব্যবসা জমেছে। একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ বয়ঃবৃদ্ধ হাতি, চুয়াত্তর, ছবি তুলছে সবাই পটাপট, ওনার জন্য চারজন সেবক। কথাটি মনে লাগল। প্যাকেজ ট্যুরে এসেছি রোটারিয়ান সৈয়দ আশরাফ ফয়েজ, সিদ্দিকুল ইসলাম ও মনসুরুজ্জামান স্ত্রীসহ। মনসুর বললেন, ওই হাতিটির চেয়েও আপনাদের দু'জনের বেশি যত্ন নিচ্ছি, ভালো কামরা, ভালো সিট ও খাদ্য তালিকার মজাদার আইটেমটি পাতে তুলে দিচ্ছি। কথাটি মিথ্যা নয়। ওদের প্রতি কৃতজ্ঞ। নারিকেল দেওয়া তরকারি ও নারিকেলের দুধের রান্না আসমার অপছন্দ। তাই 'কিং কোকোনাট', আম, কলা, আঙুর, এভোকাডো, রামভুটান স্থান করে নিল। ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বেশ ঝাল করে খেতে সুস্বাদু। আমার পছন্দ। বড়-মাঝারি হোটেলগুলোতে চিকেন, বিফ, মাটন হালাল। আরব দেশ থেকে পর্যটকরা এলে প্রথম প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হলেই 'এবাউট টার্ন'। ব্যবসা বলে কথা। প্রতি পদক্ষেপে ট্যুরিস্টদের সম্মান। নাতি-নাতনিরা এখানে এলে আর কোথাও যেতে চাইত না, সারাদিন কাটত শত হাতির সঙ্গে। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে হাতির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। লাখো মানুষ গিয়ে হাজির হতো নদীতে ওদের গোসল দেখার জন্য। শ্রীলংকার চা বাগানগুলো এক কথায় অপূর্ব। আমাদেরগুলোকেও আরও মনোরম করে সাজানো সম্ভব যেগুলোর আকর্ষণ মিলিয়ে যাওয়ার নয়। স্বপ্ন নেই। তাই স্বপ্নেরা বিস্তার পায় না।
কলম্বো মিউজিক ফেস্টিভ্যালে উদ্যোক্তা এক ভদ্রমহিলা আমার খোঁজ পেয়েছেন। বললেন, আগামী বছর এ ফেস্টিভ্যালে আপনাকে আসতেই হবে, দলবল নিয়ে। মাহিন্দর দেশে আবার যাব কোনোদিন, গাইব সমুদ্রমেখলা গালে শহরে ভাটিয়ালি গান : 'আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি, আবার দেখি নাইরে'। লিখব শ্রীলংকা নিয়ে একটি বই : 'লড়াই গেছে থেমে', যখন শ্রীলংকা আরও প্রশান্ত।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী : সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
 

No comments

Powered by Blogger.