মিসর-সামরিক বাহিনী কত দূর পেছাবে by মশিউল আলম

গত জানুয়ারি মাসে মিসরের জনগণ যখন স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে উৎখাত করতে আন্দোলন শুরু করে, তখন তাদের অধিকাংশেরই স্পষ্ট ধারণা ছিল না যে তাদের আসল সমস্যা মোবারক নয়। দেশটির সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষই যে তাদের সব দুঃখ-দুর্দশার কারণ, তা উপলব্ধি করতে তাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হলো; ভোগ করতে হলো আরও অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন।


সর্বশেষ, গত শুক্রবার থেকে পরবর্তী চার দিনে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে দাঙ্গাপুলিশের হাতে প্রাণ দিতে হলো প্রায় ৪০ জন মানুষকে, যাদের অধিকাংশই তরুণ-যুবা। আহত হয়েছে হাজার দেড়েক; আর কতজনকে যে গ্রেপ্তার করে গারদে পোরা হয়েছে, সে তথ্য পাওয়া যায়নি।
জানুয়ারি মাসের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সামরিক বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি, বরং প্রকাশ্যে বলেছে, ‘আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।’ মোবারক বিক্ষুব্ধ জনসাধারণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেনাবাহিনী মোবারকের নির্দেশ মানেনি। বরং আমেরিকাসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো যখন মোবারককে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বলে, তখন মিসরের সেনাবাহিনীও মোবারকের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়, মোবারকের পতন তরান্বিত করে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে তখন মিসরীয় সামরিক বাহিনীকে অভিহিত করা হয় মিসরীয় বিপ্লবের ‘অভিভাবক’ হিসেবে।
গত শুক্রবার থেকে মিসরের রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে আবারও যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা সেই সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে, যারা এখন আর মিসরীয় বিপ্লবের ‘অভিভাবক’ নয়, বরং ‘প্রবলতম শত্রু’। মোবারকের পতনের পর তারা সুপ্রিম কাউন্সিল অব দি আর্মড ফোর্সেস (স্কাফ) নামে এক অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ গঠন করে মিসরের শাসনক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়েছে, নয়-দশ মাস ধরে জারি রেখেছে জরুরি অবস্থা, বিক্ষোভকারীদের গুলি করে মেরেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, মোবারকের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত ১২ হাজার বিক্ষোভকারীর বিচার করা হয়েছে সামরিক আদালতে, দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড। সামরিক বাহিনী মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতায় চিরস্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে বলে ইন্টারনেটে যেসব তরুণ-যুবক লেখালেখি করেছে, তাদের ধরে কারাগারে ঢুকিয়েছে, নির্যাতন করেছে। সব ধরনের প্রতিবাদ দমনের লক্ষ্যে তারা গোয়েন্দা কায়দায় ভয়ভীতি ছড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভাষায়, হোসনি মোবারকের চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর কায়দায় দমন-পীড়ন চালিয়েছে বর্তমানের সামরিক কাউন্সিল। দেশটির শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আল বারাদেই ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগ ফোরাম টুইটারে লিখেছেন, ‘তাহরির স্কয়ারে একটা হত্যাযজ্ঞ চলছে। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হচ্ছে, তাতে নার্ভ গ্যাসের উপাদান আছে; ব্যবহার করা হচ্ছে তাজা বুলেট।’
সুপ্রিম কাউন্সিল গত মঙ্গলবার মুসলিম ব্রাদারহুড নামের কট্টরপন্থী রাজনৈতিক গ্রুপটির (মোবারকের আমলে নিষিদ্ধঘোষিত) সঙ্গে একটা সমঝোতা চুক্তি করেছে। সে চুক্তি অনুযায়ী, আগামী বছর জুনের শেষ দিকে দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা এই চুক্তি মেনে নেয়নি; বরং এর বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। মুসলিম ব্রাদারহুড চলমান বিক্ষোভ থেকে দূরে সরে রয়েছে, কারণ তারা মনে করছে, এই বিক্ষোভের আসল উদ্দেশ্য আগামী ২৮ নভেম্বর নির্ধারিত পার্লামেন্ট নির্বাচন বানচাল করা। কট্টর ইসরায়েলবিরোধী মুসলিম ব্রাদারহুডের বিশ্বাস, পার্লামেন্ট নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি সবচেয়ে বড় দল হিসেবে আবির্ভূত হবে এবং পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করবে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমেও আশঙ্কার সঙ্গে এমন সম্ভাবনার কথা লেখা হচ্ছে। কিন্তু শুধু কায়রোতে নয়, সুয়েজ ও আলেকজান্দ্রিয়াসহ আরও বেশ কয়েকটি শহরে সর্বশেষ যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে মুসলিম ব্রাদারহুডের সংশ্লিষ্টতা তেমন নেই। উদারপন্থী, মুক্তিকামী যুবসমাজ গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, কর্মসংস্থান ও শান্তির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। তাদের এসব দাবি বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা হিসেবে তারা মনে করছে সামরিক কর্তৃপক্ষকে। তাই তারা এই মুহূর্তে তাদের প্রস্থান দাবি করছে। তাহরির স্কয়ারে অবস্থান নিয়ে অনেক তরুণ ও যুবক বিক্ষোভকারী ঘোষণা দিয়েছে, প্রয়োজনে তারা প্রাণ দেবে, তবু সামরিক বাহিনী ক্ষমতা ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত তারা সেখান থেকে সরে যাবে না।
আন্দোলনের শুরুতে তাদের দাবি ছিল, কবে জেনারেলদের সুপ্রিম কাউন্সিল বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্যারাকে ফিরে যাবে তার একটা সময়সীমা ঘোষণা করতে হবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এক্ষুনি সরিয়ে একজন বেসামরিক ব্যক্তিকে ওই পদে নিয়োগ দিতে হবে; রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে এবং সংবিধান রচনার জন্য নির্বাচিত সংবিধানসভা গঠন করতে হবে। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের ওপর নজিরবিহীন নৃশংসতা চালানোর ফলে ওই সব দাবি এখন এক দাবিতে পরিণত হয়েছে, সেটা হচ্ছে এক্ষুনি সুপ্রিম কাউন্সিলকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে।
মিসরের সামরিক বাহিনী বেসামরিক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব মেনে চলায় অভ্যস্ত নয়। কিন্তু মোবারকের পতনের পর থেকে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের হাতে শাসনক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। তারা চেষ্টা করে চলেছে যতটা সম্ভব প্রক্রিয়াটিকে বিলম্বিত করতে। ২০১৩ সালের আগে তারা পুরোপুরি কর্তৃত্ব ছাড়তে রাজি ছিল না। এবং তখনো তারা এমন ব্যবস্থা করে যাওয়ার চেষ্টা করছিল যে ব্যারাকে থেকেও দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রধান অংশীদার, এমনকি অভিভাবকের ভূমিকায় তারা থেকে যেতে পারে। যে সংবিধান রচনার কথাবার্তা চলছে, সেখানে তারা এমন বিধান যুক্ত করতে চায় যে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের ওপর তারা যেকোনো সময় হস্তক্ষেপ করতে পারবে। শাসনব্যবস্থায় স্থায়ী সাংবিধানিক ভূমিকা নিশ্চিত করার পরই কেবল তারা ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ভাবছিল।
আফ্রিকা মহাদেশ ও আরব জাহানের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর দশম বৃহত্তম সামরিক বাহিনী মিসরীয় সামরিক বাহিনী দেশটির সবচেয়ে সুবিধাভোগী শ্রেণী। এর বার্ষিক বাজেট ৫.৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, দেশটির জিডিপির ৩.১২ শতাংশ (২০০৯)। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সহযোগিতা হিসেবে তারা পায় বছরে ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মিসরীয় সামরিক বাহিনী এক বিশাল ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও বটে। অলিভঅয়েল, দুধ, রুটি, খাবার পানি, সিমেন্ট, গ্যাসোলিন, মোটরযান, গৃহ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ, টেলিযোগাযোগ, হোটেল, বাণিজ্যিক হাসপাতাল, পর্যটনকেন্দ্রসহ বিশাল এক বাণিজ্যিক-সাম্রাজ্যের মালিকানা রয়েছে তাদের হাতে। এ ছাড়া খুব ঘনবসতিপূর্ণ বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ সরকারি ভূমির দখল রয়েছে সামরিক বাহিনীর হাতে; অনেক খাসজমিতে তারা বাণিজ্যিক অবকাশকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। এবং সবচেয়ে সুবিধার বিষয় হলো, সামরিক বাহিনী তার এসব ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সরকারকে কোনো কর দেয় না। বেসরকারি ব্যবসায়িক খাতকে যে আমলাতান্ত্রিক লালফিতার দৌরাত্ম্য সইতে হয়, তাদের সেসবের বালাইও নেই।
বহু বছর ধরে এত সুযোগ-সুবিধা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ভোগ করে এসেছে যে সামরিক বাহিনী, রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারত্ব তাদের খুব প্রয়োজন। মিসরীয় সামরিক বাহিনীর এখন তাই এক মরিয়া অবস্থা। কিন্তু তাদের ঝেঁটিয়ে ব্যারাকে ঢোকানো নেতৃত্বহীন স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। পাকিস্তান ও তুরস্কের মতো গণতান্ত্রিক বাতাবরণে নিজেদের রাজনৈতিক অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে তারা অনেক কলাকৌশলের আশ্রয় নেবে।
ওই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে। আমেরিকার ঘনিষ্ঠতম মিত্র ইসরায়েল অতিনিকটে; মিসরে গণতন্ত্রের বিকাশ যদি ইসলামিক ব্রাদারহুড ও অন্যান্য ইসরায়েলবিরোধী গ্রপগুলোকে শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করে, তবে আমেরিকা ও ইসরায়েলের জন্য সেই গণতন্ত্রের চেয়ে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্বই শ্রেয় মনে হবে। সামরিক কর্তৃত্ববিরোধী চলমান গণবিক্ষোভের নেতৃত্ব যেন মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর হাতে চলে না যায়, সে চেষ্টাও তারা করবে। অন্তত পশ্চিমা গণমাধ্যমের লেখালেখি থেকে সে রকমই মনে হচ্ছে।
তাহলে মিসরের মুক্তিকামী জনগণের, বিশেষত যুবসমাজের এই বিপুল আন্দোলন কী ফল বয়ে আনে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.