মুসলিম দেশগুলোতে রাজনীতির অসামরিকীকরণ-আন্তর্জাতিক by শহীদ জাভেদ বুরকি

মিসরে সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর রাজনৈতিক উত্তরণের পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ছিল সেদেশের আন্দোলনকারী জনতার কাছে অগ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে কি ইসলামপন্থি কি ধর্মরিপেক্ষ সবারই অভিন্ন মত ছিল মুসলিম সরকারগুলো কি তাদের দেশকে শক্তিধর সামরিক বাহিনীর কবজা থেকে মুক্ত করে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? মিসর, তুরস্ক ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর সামনে এ প্রশ্নটিই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ লড়াই শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে সম্পর্কে ভবিষদ্বাণী করার জন্য ইসলামী দুনিয়ার অতীত উপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনীতি ও সরকার পরিচালনার সঙ্গে সামরিক শক্তির গভীর সম্পৃক্তির ঐতিহ্য অনুসৃত হতে দেখা যায়। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য, ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল ও ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সামরিক শক্তি ভূমিকা পালন করে। আর যে কোনো বিজিত দেশে যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সেখানে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সামরিক শক্তি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
অটোমান সাম্রাজ্য রাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক বাহিনীর আত্তীকরণটা অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর শাসকরা ইসলামী শাসনের অধীনে আসা ইউরোপীয় ভূখণ্ড থেকে সামরিক বাহিনীর সদস্য সংগ্রহ করে এক নতুন ধরনের সামরিক বাহিনী গড়ে তোলে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলোতে সামরিক বাহিনীর প্রাধান্য বজায় ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে সৃষ্ট শূন্যতা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো পূরণ করে। এসব ঔপনিবেশিক শক্তির নিজস্ব সামরিক বাহিনী ছিল। তাই শাসনের জন্য তাদের স্থানীয় লোকদের সমবায়ে সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ইউরোপীয়রা বিংশ শতাব্দীতে এসব দেশ থেকে চলে গেলে পুরনো শক্তি তাদের শূন্যস্থান পূরণের জন্য এগিয়ে আসে এবং এভাবেই সামরিক শক্তি রাজনীতি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
মিসর, পাকিস্তান ও অন্য আরব দেশগুলোতে সামরিক বাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সেই বিংশ শতাব্দীর প্রথম ও মধ্যভাগে। ১৯২৩ সালেই কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের সামরিক বাহিনী ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের অভিভাবক হিসেবে অবতীর্ণ হয়। তিনি নিজেও সামরিক বাহিনীর লোক ছিলেন।
মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে আজ যে বিপ্লব আলোড়িত করে চলেছে তা ইসলামী সামরিক বাহিনীর অতীতের কারণে অনেকটা গোলমেলে। এসব গণঅভ্যুত্থানের প্রথম পর্যায়ে যারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত ছিল তাদের সেসব অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিটাই ছিল প্রধান। এখন দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। এই পর্যায়ে পুরাতন সামরিক এস্টাবলিশমেন্টকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জোরালো প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। মিসর, পাকিস্তান ও তুরস্ক একটা ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় অর্জনের চেষ্টা করছে।
মিসরে সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর রাজনৈতিক উত্তরণের পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ছিল সেদেশের আন্দোলনকারী জনতার কাছে অগ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে কি ইসলামপন্থি কি ধর্মরিপেক্ষ সবারই অভিন্ন মত ছিল। অধিকাংশ মিসরবাসীই চান সামরিক বাহিনী রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাক। মিসরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ আসন বিজয়ী ইসলামী ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টির এসাম এল এরিয়ান বলেছেন, তারা মনে করেন না সামরিক বাহিনী স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেবে।
তাদের ক্ষমতা ত্যাগের জন্য রাজি করাতে হবে, এতে কাজ না হলে তাদের শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিতে হবে। পার্লামেন্টকে ১০০০ সদস্যের পরিকল্পিত সাংবিধানিক সংসদ বেছে নেওয়ার কর্তৃত্ব খাটানোর জন্যই শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি করতে হতে পারে।
ইত্যবসরে তুরস্কে ইসলামী ঐতিহ্যের অনুসারী দল ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সে দেশে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা সীমিত করার চেষ্টা করছে। সামরিক বাহিনী অবশ্য তাদের ওপর তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক ঐতিহ্য রক্ষা করার সাংবিধানিক ম্যান্ডেট থাকার কথা বলছে। তুরস্কের সামরিক বাহিনী কামালবাদ প্রতিষ্ঠার কথা বলে বার কয়েক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করেছে। আতাতুর্কের আধুনিকায়নের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির কারণেই তুরস্ক ইউরোপীয় ধরনের উদারতাবাদ অনুশীলন করে। তবে উলি্লখত তিন ইসলামী দেশের মধ্যে তুরস্কই সফলভাবে রাজনীতিকে অসামরিকীকরণ করতে সমর্থ হয়েছে। ক্যারিশম্যাটিক প্রধানমন্ত্রী পরপর তিনবার নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে সরকার গঠন করে সামরিক বাহিনীর ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছেন।
সব শেষে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের ৬৪ বছরের মধ্যে অর্ধেক সময় দেশটি শাসনকারী সামরিক বাহিনী নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব বজায় রাখার জন্য কঠিন লড়াইয়ে রয়েছে। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার অভিযানসহ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান পরিচালনার রাশ টেনে ধরার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। সম্প্রতি প্রবল বিরোধিতার আশঙ্কায় পাকিস্তানের জেনারেলরা রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা নেই বলে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করেছেন। আরব বসন্ত (গণঅভ্যুত্থান) শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ওই অঞ্চলে দীর্ঘদিন থেকে ক্ষমতায় থাকা চারটি সরকারের পতন হয়েছে। অন্য সরকারগুলোও অব্যাহত চাপের মধ্যে রয়েছে। ফলে সাধারণ আরব জনগণ আশা করছে, তাদের দাবি আর উপেক্ষিত হবে না এবং যারাই ক্ষমতায় আসবেন তারাই সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে মনোযোগী হবে। তবে প্রকৃত বিপ্লব তখনই ঘটবে যখন সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে এসব দেশের জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিরা দেশের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করবে।

শহীদ জাভেদ বুরকি :পাকিস্তানের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বর্তমানে লাহোরে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক পলিসির চেয়ারম্যান; খালিজ টাইমস থেকে ভাষান্তর

No comments

Powered by Blogger.