কর ন্যায়পাল অফিস বহাল হোক-আয়কর দিবস by মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

রাজস্ব আহরণে ও পরিশোধে করদাতা এবং আহরণকারীর পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, উপলব্ধি ও সম্মান সমীহ বোধের বিকাশ ঘটাতে উভয় পক্ষের মনমানসিকতার পরিবর্তনের প্রত্যাশাই এবারের জাতীয় আয়কর দিবসের মূল ভাবনা হতে পারে।


করদাতাকে যদি কর আহরণকারী আস্থায় না আনতে পারেন, তাকে সহায়তা-সহযোগিতার মনোভাব না প্রদর্শন করতে পারেন, তাহলে করদাতা নিজেকে উন্মুক্ত করবেন না তার কাছে। সমাজে যদি কর পরিশোধযোগ্য দশজন বাস করে এবং রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা যদি হয় ১০ টাকা, তাহলে প্রত্যেকে ১ টাকা করে কর দিলে চলে। কিন্তু কর পরিশোধযোগ্য হয়েও যদি ৮ জন কর পরিশোধের আওতায় না আসে তাহলে যে দু'জন কর পরিশোধ করে তাদের ওপর গিয়ে পড়ে ১০ টাকা পরিশোধের পুরো চাপ। আয়-রোজগার সেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কি পায়নি সেটার দিকে না তাকিয়ে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং সে সূত্রে নানা বিসংবাদ সৃষ্টি হতে পারে, যা কর প্রদানে নিরুৎসাহিত করতে পারে। এটা মনে হতে পারে সর্বোচ্চ ২৫% কর দিতে যে কোনো একজন করদাতার পক্ষে কষ্টকর। ক্ষেত্র মতে, অবিবেচনাপ্রসূত এবং নিরুৎসাহব্যঞ্জক। আয়করের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন যদি যথাযথ রাখতে হয় তাহলে করদাতার সংখ্যা না বাড়লে রাষ্ট্রের পক্ষে করের হার কমানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে সঠিক শুল্ক পরিশোধে কতিপয়ের উপেক্ষা ফাঁকিজুঁকি ও অপারগতার চাপ দায়িত্বশীলদের ওপর গিয়ে বর্তায়। করদাতার সংখ্যা বাড়লে কিংবা শুল্কের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে হার কমিয়েও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। করদাতার সংখ্যা কম থাকলে তাদের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয় তা কর আইনের প্রয়োগকেও জটিল করে তোলে। ফলে কর জালের আওতায় আসতে অন্যরা নিরুৎসাহ বোধ করে। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক অধিগ্রহণকৃত এ দেশীয় ভূমির মালিকানা সূত্রে খাজনা সংগ্রহের দায়িত্ব জমিদার শ্রেণীর কাছে অর্পিত হয়। জমিদাররা জমির প্রকৃত মালিক ছিল না, তারা জমির চাষবাসেও ছিল না, তারা কোম্পানির হয়ে খাজনা সংগ্রাহক ছিল মাত্র। এই সংগ্রহ কাজে কোম্পানিকে দেয় পরিশোধের পর উদ্বৃত্ত কমিশন হিসেবে প্রাপ্তির প্রত্যাশী ছিল মধ্যস্বত্বভোগী এই সিন্ডিকেট। ফলে রায়তের সঙ্গে খাজনা সংগ্রহ কর্মে তাদের সম্পর্ক শেষমেশ জুলুম বা জোর-জবরদস্তির পর্যায়ে পেঁৗছাত। খাজনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে আদায় শব্দটি সেভাবে একটা জোর-জুলুম, অত্যাচার, আত্মসাতের প্রতিভূ হিসেবে বিদ্যমান হয়ে দাঁড়ায়। দুঃখের বিষয়, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন দেশে, ঔপনিবেশিক আমলের এসব 'আদায়ের' মানসিকতা অব্যাহত থাকা বাঞ্ছনীয় হতে পারে না।
আয়করের দর্শন হলো রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস করে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি আয় বা সম্পদ অর্জিত হলে রাষ্ট্র তার একটা নির্দিষ্ট অংশ 'সমাজে সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা বিধান এবং আয়-উপার্জনের পরিবেশ সৃজন তথা অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ আয়-উপার্জনের পরিমাণভেদে একটা হিস্যা' হিসেবে প্রাপ্য হিসেবে চাইতে পারে। ভূমি করের ক্ষেত্রে আগে রাষ্ট্র ভূমি বরাদ্দ দেয় এবং তার ভিত্তিতে খাজনা দাবি করে এখানে লেনদেন প্রকাশ্য। কিন্তু আয়করের ক্ষেত্রে লেনদেন অপ্রকাশ্য, রাষ্ট্র সৃজিত সুযোগ-সুবিধা সবাই ভোগ করলেও সবাই আয় বা সম্পদ অর্জন করতে পারে না। নিজের মেধা, বুদ্ধি, পরিশ্রম প্রয়োগ করে সম্পদ অর্জন করতে হয়। এ দেশে আয়কর আইন প্রবর্তন হওয়ার সমসাময়িক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় দেখা যায়, একটা ঔপনিবেশিক সরকার এর প্রবর্তক আর কর সংগ্রহ কার্যক্রমটি 'আদায়' মানসিকতা দ্বারা শাসিত। শাসক আর শাসিতের মধ্যে কর আরোপের আর আদায়ের প্রসঙ্গটি রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক দায়িত্ব পালনের দর্শনের ভিত্তি রচনার পরিবর্তে রাজা প্রজা প্রভু ভৃত্য বিদেশি বেনিয়া আর দেশীয় প্রতিপক্ষ সুলভ। ফলে কর বা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার, সংশয় সন্দেহের, জোর-জবরদস্তির কিংবা পাকড়াওকরণের চিন্তাচেতনা প্রসূত হয়ে ওঠে। ঈড়ষষবপঃরড়হ ড়ভ ঃধী (ড়ৎ ৎবাবহঁব) হয়ে ওঠে আদায় করার বিষয়। রাজস্ব আহরণকারীর মনোভাব ভঙ্গিতে আইনের দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত 'আদায়কারী' প্রতিভূ হিসেবে প্রতিভাত হয়। আমি মনে করি, কর ন্যায়পাল ব্যবস্থার প্রবর্তনও করদাতা এবং আহরণকারীর মধ্যকার আস্থা সৃজনের সহজ করতে পারে। কর আহরণে কর অফিসের কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাক্ষমতার অপপ্রয়োগ, বাড়াবাড়ি, কিংবা নিবর্তনমূলক কোনো পথ পন্থা কিংবা পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তার প্রতিকার প্রার্থনার ও অনুযোগ শোনার সুযোগ সৃষ্টির জন্য কর ন্যায়পাল পদের প্রবর্তন। পৃথিবীর ১১৪ দেশে ২৭০ কর ন্যায়পালের দফতর আছে। কর ন্যায়পাল আইন ২০০৫-এর আওতায় বাংলাদেশে ২০০৬ সালে কর ন্যায়পাল অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। কর ন্যায়পাল আইনে প্রতিকার প্রার্থনার পথ পন্থা নির্দেশিত ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর আইনগুলোতে (আয়কর অধ্যাদেশ, শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর) সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানের সংযোগ সাধন তথা সামঞ্জস্যকরণের কাজ শেষ না হওয়ায় কর ন্যায়পাল অফিসের ভূমিকা অর্থবহ রূপ পেতে বিলম্ব হয় এবং সে সুবাদে এই প্রতিষ্ঠানটির অবলুপ্তি ঘটেছে। কর ন্যায়পাল অফিসকে কার্যকর করার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নিশ্চিত করা গেলে করদাতাদের আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে অবশ্যই গঠনমূলক অগ্রগতি সাধিত হতো।

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ :সাবেক সচিব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
 

No comments

Powered by Blogger.