ষাটের দশকের গণজাগরণ ও অজিত রায়-ফিরে দেখা by শেখর দত্ত

'অজিতদা নেই।' টেলিফোনে এই শব্দ দুটি শুনে বিয়োগ-বেদনার তড়িৎ-প্রবাহ সমস্ত শরীর-মনকে লণ্ডভণ্ড করে দিল। কাকতালীয় কি-না জানি না। তখনই পত্রিকায় পড়ছিলাম, ষাটের দশকে তার কণ্ঠে জনপ্রিয় হওয়া গানটি 'বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা।


' গানের এ লাইন দুটি ছিল ঈদোৎসবের দিনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার শুভেচ্ছা বিনিময়ের সংবাদ রিপোর্টে। তিনি ওই দুটি লাইন প্রসঙ্গক্রমে উচ্চারণ করেছিলেন, তাই ছাপা হয়েছে। পড়ে নিজ মনে হাসছিলাম। কারণ ক্ষমতায় থাকতে কোনোদিন বিএনপি নেত্রীর মুখে গানের কোনো কলি শুনিনি। অজিতদা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আছেন, এমন খবরটা আজই পেলাম পত্রিকা পড়ে। অথচ আজ থেকে সাড়ে চার দশক আগে আমরা এক বিছানায় ডাবলিং করতাম। সময়ের কী বিচিত্র গতি! কখনও কাছে টেনে আনে, আবার বিচ্ছিন্নও করে দেয়।
বাস্তবে সময়ই হচ্ছে জীবনের সারথী। নতুবা রংপুরের লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া গানপাগলা রথু (অজিত রায়) কি এভাবে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে জনগণনন্দিত গণসঙ্গীত গায়ক অজিত রায় হতে পারতেন? ১৯৬৬ সালের শেষ দিক। ৭ জুনের হরতালের পর আইয়ুব-মোনায়েমের দমন-পীড়নে ছাত্র সংগঠনগুলো বিশেষভাবে ছাত্রলীগ বিধ্বস্ত। ৬ দফা সমর্থন করা কিংবা না করা এবং রুশপন্থার বিপ্লব নাকি চীনপন্থার বিপ্লব সঠিক প্রভৃতি নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত। এই অবস্থায় পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলন দমন-পীড়ন দিয়ে বাগে আনতে পারা গেছে মনে করে আইয়ুব-মোনায়েম সরকার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন জোরদার করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'হিন্দু' এবং তার গান পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী_ এ অভিযোগে রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিদ্রোহী কবি নজরুলের গান ও কবিতা থেকে 'হিন্দুয়ানি' শব্দ বাদ দিয়ে খণ্ডিত করে প্রচার করা হতে থাকে। বাংলা ভাষা রোমান হরফে লেখা কিংবা বাংলা-উর্দু মিলিয়ে 'লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা' অর্থাৎ বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করতে অদ্ভুত এক সংকর ভাষা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালানো হয়।
এ অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নেয়, পাকিস্তানি শাসক-শোষক গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিহত এবং সে সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ছাত্র সমাজকে জাগ্রত ও ঐক্যবদ্ধ করে রাজনৈতিক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রসঙ্গত তখন ছাত্র সংগঠনগুলোতে একটা ধারা চালু ছিল যে, মফস্বলে যেসব ছাত্রনেতা আন্দোলন-সংগঠনে অগ্রণী, তাদের ঢাকায় আসতে উৎসাহিত এবং প্রয়োজনে সাহায্য-সহযোগিতা করা। একইভাবে সাংস্কৃৃতিক আন্দোলনে যখন গুরুত্ব দেওয়া হয়, তখন জেলা-মহকুমা তথা মফস্বলের উঠতি শিল্পীদের ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ। পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি গণসঙ্গীতের ডিমান্ড খুব। আলতাফ মাহমুদ, জাহেদুর রহীম, শেখ লুৎফর রহমান প্রমুখ সামাল দিতে পারছেন না। এমন সময়ে জানলাম অজিত রায় নামে এক যুবক আছেন রংপুরে। গণসঙ্গীত-রবীন্দ্রসঙ্গীত দুটিই গান। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) রাজনীতির সমর্থক। রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে থাকেন। যতটুকু মনে পড়ে, তখনকার জনপ্রিয় ছাত্রনেতা সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক কিংবা পংকজ ভট্টাচার্য রংপুরে ছাত্র ইউনিয়ন জেলা সম্মেলন থেকে ফিরে এসে জানান, গণসঙ্গীত গায়কের অভাব অজিত রায় পূরণ করতে পারবেন। ছাত্রনেতা সামসুদ্দোহার বাড়ি ছিল রংপুরে, তিনিও নিশ্চিত করলেন। ঢাকা আসতে চান অজিত রায়ও। ছাত্রনেতা আবুল হাসনাত (সম্পাদক, কালি ও কলম) ছিলেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার দায়িত্বে। সব শুনে তিনিসহ আমরা সবাই উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। নভেম্বর '৬৬, ছাত্র ইউনিয়নের দশম প্রাদেশিক সম্মেলন। সাব্যস্ত হলো সম্মেলনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এমনভাবে করতে হবে যাতে অতীতের সব রেকর্ড ম্লান হয়ে যায়। সারাদেশের আনাচে-কানাচে থেকে ছাত্র প্রতিনিধিরা আসবেন, সেই সুযোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করতে হবে। যাতে মফস্বলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করায় জোর পড়ে। রবীন্দ্রনাথের 'তাসের দেশ' নাটক, নজরুলের 'বিদ্রোহী' নাট্যানুষ্ঠান, ছায়ানাট্য 'লাল রং পলাশ' আর সেই সঙ্গে থাকবে গণসঙ্গীতের আসর 'এ দেশ আমার গর্ব।' গণসঙ্গীত অনুষ্ঠান সফল করতেই অজিত রায়কে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। রংপুরে টেলিগ্রাম গেল। ফিরতি টেলিগ্রামে জানা গেল তিনি আসছেন। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে আমাকে। রেলস্টেশন থেকে তাকে আনা হলো জগন্নাথ হলে। বন্ধু ক্লাসমেট সোমেশ্বর চক্রবর্তীর (সাবেক অধ্যাপক, কক্সবাজার কলেজ) রুম ছিল উত্তর বাড়ির ১১০ নম্বর। গভীর রাত পর্যন্ত সংগঠনের কাজ করে আমরা ওখানেই এসে গাদাগাদি করে ঘুমিয়ে থাকতাম। রুমে ছিল দুটি সিঙ্গেল চৌকি। মাটিতেও কোনো কোনো রাতে বিছানা হতো। স্থির হলো একটা চকিতে অজিত রায় থাকবেন ডাবলিং করে। আমরা নিজেরা ঠিক করলাম প্রয়োজনে আমাদের দু'তিনজনের খাবার রুমে এনে নেব এবং তা ভাগ করে খাব। যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার কী প্রচণ্ড শক্তি যে ছিল তার, ভাবাই যায় না। স্টাইলিস্ট ও ছিমছাম স্বভাবের অজিত রায় সবটাই মেনে নিলেন। তিনি যে নিজেকে বিপ্লবী গায়ক বলে মনে করেন। প্রথম পরিচয়েই আমাদের একান্ত আপন করে নিলেন। এক হাত হাতে রেখে আর অন্য হাত পিঠে দিয়ে অগ্রজসুলভ হেসে বললেন, 'অজিতদা নয়, আমি রথুদা।' মা সেই নামে ডাকতেন, তাই নামটার প্রতি ছিল তার অশেষ দুর্বলতা।
দশম প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রথম গান গেয়েই আমাদের রথুদা গণসঙ্গীত গায়ক অজিত রায় হয়ে উঠেছিলেন। তারপর ঢাকায় স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবার উপায় ছিল না। ওই ছোট রুমে ঠেলা-ধাক্কা আর রাজনৈতিক হট্টগোলের পরিবেশে তার মতো প্রতিভাবান শিল্পীর থাকা যে অসুবিধাজনক, তা বুঝতে পারি। সঙ্গীতের জন্য পরিবেশ দরকার। রেওয়াজ করবেন কোথায়? শুরু হলো চাকরি খোঁজা। কিন্তু কে দেবে সরকারবিরোধী গণসঙ্গীত গায়ককে চাকরি!
কতদিন ছিলেন তিনি জগন্নাথ হলে? সোমেশ্বর চক্রবর্তী জানান, কমবেশি দেড় বছর তো হবেই। ক্রমেই জেলা, মহকুমাসহ আনাচে-কানাচে থেকে ডাক আসতে লাগল। আজ এখানে ছাত্র ইউনিয়ন সম্মেলন ও নবীন বরণ, তো কাল সেখানে ছাত্র সংসদ অভিষেক কিংবা জনসভার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চাকরি না থাকাটা একদিক থেকে সুবিধাই হলো। রথুদা ঢাকার বাইরে ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণীতে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কনসেশন টিকিটে যেতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। তখন ট্রেনে ছাত্রদের ভাড়া ছিল অর্ধেক। অবশ্য এজন্য ফরম পূরণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতি নিতে হতো। জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, প্রখ্যাত দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেব একসঙ্গে অনেকগুলো কনসেশন ফরমে সই করে দিতেন। কেবল গণসঙ্গীত নয়, দেশাত্মবোধক রবীন্দ্র-নজরুল-দ্বীজেন্দ্র-সুকান্ত সঙ্গীত গেয়েও তিনি ছাত্র-জনতাকে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উজ্জীবিত করতে লাগলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আহূত জনসভার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে তিনি ছিলেন অপরিহার্য। ট্রাকে চড়ে তিনি গভীর রাত পর্যন্ত ছাত্র-জনতাকে গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করতেন। 'ধন-ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা' গানটি তিনি কোরাস গেয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি' গাইতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী জাহেদুর রহীম।
জগন্নাথ হলে বহিরাগত ছিলেন রথুদা। হল-হোস্টেলে বহিরাগত থাকা নিয়ে এখন সমালোচনা হয়। কিন্তু অজিতদা হলে থাকতেন বলে জগন্নাথ হলের ছাত্ররা পর্যন্ত গর্ববোধ করত। তার কারণে অনেক শিল্পী আমাদের হলে আসতেন। এ সময়ে খন্দকার ফারুকের সঙ্গে অজিতদার বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়। টেবিলকে তবলা বানিয়ে কিংবা দুই আঙুলে তাল দিয়ে গানে খুবই উৎসাহী ছিলেন খন্দকার ফারুক। বাড়ি থেকে চিঠি আসত সোমেশ্বর চক্রবর্তীর নাম কেয়ার অব দিয়ে। মায়ের কাছে তিনি কেবল গানই শেখেননি, শুদ্ধ উচ্চারণে স্পষ্টতা ও শুদ্ধতার তালিমও নিয়েছিলেন। এদিকে রটে গেল যে, কোনো কোনো চিঠি তিনি আমাদের সামনে খোলেন না। তরুণ বয়সী আমরা, কৌতূহল প্রবল। শেষ পর্যন্ত কিছুই গোপন রইল না। রথুদা প্রেম করেন এবং হবু বৌদির নাম দোলা। এ নিয়ে আমরা অজিতদাকে বিরক্ত করতাম। তবে রাগ করতে তাকে দেখিনি।
শহীদ মিনারে কফিনে রথুদার মুখটা দেখলাম। সেই হাসি কোথায়! সেই মায়াবী চোখ! ভরাট চেহারা! না দেখলেই বোধকরি ভালো করতাম। প্রচণ্ড শোক বুকে নিয়ে আমরা কয়েকজন যাই পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটে। হঠাৎই দমকা বাতাসের সঙ্গে এক ঝলক মৃদু বৃষ্টি। আমাদের মনে হলো, বাংলার আকাশ-বাতাস যেন অজিত রায়কে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে গেল। শ্মশানের একদিকে পাহাড়ের মতো ফুল আর ফুল, ওগুলো অজিত রায়ের প্রতি দেশবাসীর শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য। সেখানে রয়েছে রাষ্ট্র্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীরও পুষ্পার্ঘ্য। আমরা বলাবলি করলাম, মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়কদের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ই মৃত্যু ভালো। তাতে জাতীয় বীরদের শেষ স্বীকৃতিটুকু জাতির পক্ষ থেকে দেওয়া সম্ভব। এ পর্যবেক্ষণ যে কতটুকু সঠিক তা প্রমাণিত হয় মন্ত্রিসভায় ৫ সেপ্টেম্বরের সিদ্ধান্ত থেকে। সঙ্গীতশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা অজিত রায়ের মৃত্যুতে মন্ত্রিসভা শোক প্রস্তাব গ্রহণ করার পর এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, শিল্পী কল্যাণ তহবিল গঠন এবং এ তহবিল থেকে শিল্পীদের চিকিৎসাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে সহায়তা দেওয়া হবে। অজিত রায়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মৃত্যুতেও অজির রায় জাতির চোখকে খুলে দিয়ে গেলেন। অজিত রায়ের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতি কিছুটা হলেও দায়মুক্ত হলো। অজিত রায়ের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ প্রণতি।

শেখর দত্ত : সাবেক ছাত্রনেতা
 

No comments

Powered by Blogger.