এনজিও ও সামাজিক খাতে ক্রয় নীতিমালা-সুশাসন by এসএম নাজের হোসাইন

বাংলাদেশে এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, মঙ্গাপীড়িতদের কল্যাণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে এনজিওগুলোর অবদান এবং এদের সমন্বয়হীনতা নিয়ে আলোচনা চলছে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে এ ভূখণ্ডে এনজিও নামের উপস্থিতি তেমন ছিল না। তবে সমাজহিতৈষী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ দেশ ও সমাজে সবসময় ছিল এবং এখনও আছে।


স্বাধীন হওয়ার পর এরূপ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজের ধরন ও চরিত্র প্রয়োজনের তাগিদেই বদলাতে থাকে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর কাজের সঙ্গে যোগ হতে থাকে উন্নয়নের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ, বৈদেশিক সাহায্য, জন্মাতে থাকে পেশাদারিত্বের তাগিদ এবং উদ্যোগের ধারাবাহিকতা, নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তার বিধান। সাধারণ অর্থে এনজিও বলতে সেসব সংগঠনকে বোঝায়, যারা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ধারাবাহিকভাবে সম্পৃক্ত। তবে দেশে এনজিওগুলোর শীর্ষ সমন্বয়কারী সংস্থা এডাবের মতে, তাদেরই এনজিও বলে বিবেচনা করে, যারা সংগঠন হিসেবে সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত, নিজস্ব গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত, যাদের নিজস্ব অফিস আছে, পূর্ণকালীন কর্মী আছে, ধারাবাহিকভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি, কর্মএলাকা ও উপকারভোগী আছে, ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ও এর প্রয়োগ আছে, বার্ষিক কার্যক্রমের প্রতিবেদন আছে, বার্ষিক বাজেট ও আয়ের উৎস আছে, নিয়মিত বার্ষিক অডিট হয় এবং যাদের উন্নয়ন কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা ও পেশাদারিত্বের ছাপ আছে, আছে কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।
বাংলাদেশে এনজিওগুলোর তহবিল ছাড় করাতে বিড়ম্বনা, সরকার ও এনজিও শীতল সম্পর্ক, এনজিও সেক্টরে সংঘটিত দুর্নীতি এবং ইমেজ সংকটের কারণে দাতা সংস্থাগুলোও বাংলাদেশে এনজিওগুলোর মাধ্যমে সাহায্য প্রদানে ক্রমান্বয়ে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে। এনজিও সেক্টরের এ স্থবিরতা গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। আগে সমন্বিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে এডাব এনজিওগুলোর প্রতিনিধিত্ব করত; কিন্তু এখন রাজনৈতিকভাবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে সামাজিক উন্নয়ন খাতে এনজিও ও সিটিজেন সেক্টরের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে না।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন বহুজাতিক দাতা সংস্থার সহায়তাপ্রাপ্ত সরকারি প্রকল্পগুলোতে এনজিও নিয়োগে টেন্ডার প্রথা চালু, পে-অর্ডার, ব্যাংক গ্যারান্টি, টিআইএন দাখিল, এনজিও নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট এনজিও নিয়োগ এবং অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি দাতা সংস্থার অনুদান পেতে স্থানীয় এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতা, দক্ষ জনবল, প্রস্তাবিত কর্মএলাকায় অবস্থান ইত্যাদি যোগ্যতা বাদ দিয়ে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের বিশাল অঙ্কের ঋণ তহবিল, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির লাইসেন্স আছে কি-না এবং পিকেএসএফের পার্টনার, বিশাল দালান-স্থাপনা আছে কি-না ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্যতম যোগ্যতা নির্ধারণ করে প্রকারান্তরে এনজিওগুলোকে ব্যবসায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। ফলে অনেকেই গাছ, বাঁশ, রিয়েল স্টেট ব্যবসার ফাঁকে নতুন করে এনজিও ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েছে। মজার বিষয়, সরকারি অন্য সব সেক্টরে কেনাকাটার জন্য প্রণীত পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৮-এর আওতায় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে এনজিও নিয়োগ করে এনজিও কার্যক্রমকে ঠিকাদারি ব্যবসায় পরিণত করা হয়েছে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্টের মাধ্যমে অনেক প্রকল্পে এনজিও নিয়োগ করা হচ্ছে, যেখানে সাধারণ ব্যবসায়ী ফার্মের মতো এনজিও নিয়োগের কারণে টেন্ডারে অভিজ্ঞ এনজিওগুলোই নির্বাচিত হচ্ছে। অন্যদিকে উপানষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প চখঈঐউ-০২-এর আওতায় এনজিও নিয়োগে প্রতি জেলার জন্য একটি লিড এনজিও ও কয়েকটি সহযোগী এনজিও নির্বাচনের বিধান করা হয়েছে। অথচ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতি উপজেলায় ১০-১৫টি এনজিও কাজ করা সুযোগ পেত। একই সঙ্গে ইঊঐঞজটডঈ প্রকল্পেও এনজিও নিয়োগে ৫ বছরের অভিজ্ঞতাকে অন্যতম যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়েছে। এখানে ঢাকার কয়েকটি বৃহৎ ব্যবসায়িক এনজিওকে কাজ প্রদান এবং এনজিওতে সিন্ডিকেট ব্যবসা অব্যাহত রাখার জন্য এ ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। বিগত জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদফতরের পিএলসিএইচডি-১, ২, হার্ড টু রিচ প্রকল্প, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্প, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ঈউগচ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পুষ্টি প্রকল্প (ঘঘচ), অওউঝ/ঐওঠ ও এঋঅঞগ-এর আওতায় গধষধৎরধ ঈড়হঃৎড়ষ চৎড়মৎধসসব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভিজিডি কর্মসূচি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের ঊইজওউচ ইত্যাদি প্রকল্পে যেভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে এবং যারা নগদ অর্থ প্রদান করতে পেরেছেন শুধু তারাই এনজিও হিসেবে নির্বাচিত হতে পেরেছেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কর্মসূচিতেও দুর্নীতির মাধ্যমে এনজিও নিয়োগ করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের আমলে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রকল্পেও একই ধারায় কতগুলো এনজিও নির্বাচন করা হয়েছিল। যদি কোনো এনজিও কাজ পাওয়ার জন্য অর্থলগি্ন করে থাকে, তাহলে ওই প্রকল্প থেকে মুনাফা প্রত্যাশাই স্বাভাবিক। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দফতরের সঙ্গে সখ্যের সুযোগে ঢাকাভিত্তিক কয়েকটি এনজিও দেশব্যাপী অনেক সরকারি প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানে স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ক্ষুুদ্র ও মাঝারি এনজিওগুলো তহবিল না পেয়ে অস্তিত্বের সংকটে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। অথচ স্থানীয় এনজিওকে কাজটি দেওয়া হলে স্থানীয় উদ্যোগ উৎসাহিত হতো, প্রকল্পের ব্যয় কমত, প্রকৃত উপকারভোগীরা স্থানীয় এনজিও থেকে অধিক সেবা পেত। কিন্তু টেন্ডারবাজ এনজিওগুলোর কাজ দেওয়ার ফলে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে না হতেই ওই এনজিও অফিস গুটিয়ে নিচ্ছে।
এছাড়াও সিন্ডিকেটভুক্ত এনজিওগুলোর স্বার্থ রক্ষা ও তাদের নিয়োগের জন্য প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এনজিও বাচাই, নির্বাচন ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় এমন কতগুলো নীতিমালা প্রণয়ন, শর্ত জুড়ে দেন ও অনুসরণ করে থাকেন, যাতে তাদের পছন্দের বাইরে অন্যদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না। টেন্ডার প্রক্রিয়াটি শুধু লোক দেখানো। বিগত চারদলীয় জোট সরকার তাদের তল্পিবাহক সুবিধাবাদী ও ব্যবসায়িক ধারার এনজিওগুলোকে সুবিধা দিলে সবগুলো আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। অনেকে আবার বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে এবং সে কারণে বাংলাদেশে এনজিও সেক্টরে একটি চরম বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন বহুজাতিক দাতা সংস্থার অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্পে এনজিও নিয়োগে বিডিংয়ের নামে ক্যান্সার প্রতিরোধ প্রকল্পে কনস্ট্রাকশন ফার্মকে পুষ্টি প্রকল্পে, স্টেশনারিজের দোকানের মালিককে এনজিও নিয়োগ, প্রকল্পে নিয়োগ পেতে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ প্রথা চালু, সামাজিক ব্যবসার নামে এনজিওকে বাণিজ্যিকীকরণে স্বার্থান্বেষী মহলের অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে।
তাই জরুরিভাবে এনজিও সেক্টরে ব্যবসায়িক ধারার উত্থান ও প্রসার বন্ধে এনজিও ও সামাজিক সেক্টরের জন্য পৃথক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট তৈরি করা প্রয়োজন। যেখানে সরকারি প্রকল্পে এনজিও নিয়োগে স্থানীয় উদ্যোগকে উৎসাহিত করা, স্থানীয় এনজিও নিয়োগের বিধান নিশ্চিত করা, কোনোভাবেই করপোরেট এনজিওগুলো যেন রাজনৈতিক ও আমলা চক্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সরকারি তহবিল আত্মসাৎ করতে না পারে সে জন্য বিধান তৈরি করা আবশ্যক।

এসএম নাজের হোসাইন : নির্বাহী পরিচালক, আইএসডিই, বাংলাদেশ
isdebangladesh@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.