মা ইলিশ বনাম জেলে সন্তান by জামান সরদার

পকূলীয় অঞ্চলে এখন অভিযান চলছে। যেসব জেলে মা ইলিশ ধরছেন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান। বিভিন্ন এলাকা থেকে কেবল মণকে মণ ইলিশ উদ্ধার নয়, এর সঙ্গে জড়িত জেলেদের কারাদণ্ড দিচ্ছে, জরিমানা করছে প্রশাসন। কোথায় কী পরিমাণ ইলিশ আটক হয়েছে, কতজন জেলে দণ্ড পেয়েছেন, গত কয়েক দিনে তা সংবাদমাধ্যমের নিয়মিত শিরোনামে পরিণত হয়েছে। তবে জীবিকা বলে কথা। পেটের দায় বড় দায়। প্রশাসনের কড়াকড়ি আর জেলেদের কৌশলের যেন পাল্লা


চলছে। ইলিশ ধরতে নিজেরা না গিয়ে জাল ও নৌকা দিয়ে শিশুসন্তানকে নদীতে পাঠাচ্ছেন জেলে মা-বাবা। প্রশাসনের নজরদারির কাছে সে কৌশলও মার খেয়েছে। কয়েকটি শিশু এমন অপকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। সে ক্ষেত্রে জাল, নৌকা ও ইলিশ হয়তো কেড়ে নেওয়া যায়; জরিমানার সুযোগ কোথায়? ৮-১০ বছরের শিশুকে কারাগারেই-বা পাঠায় কীভাবে? সুতরাং অন্য ব্যবস্থা। সমকালে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি শিশু কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
সন্দেহ নেই, এ মাসের গোড়ায় উপকূলীয় এলাকার সাত হাজার বর্গকিলোমিটার জলসীমায় পূর্ণিমার আগে-পরের ১০ দিন ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে সরকার যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, এসব শিশু তা স্পষ্টতই ভঙ্গ করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে শিশুদের শাস্তি দেওয়া কি আইনসম্মত? এ বিধান কোথায় আছে যে, শিশুকে এমন অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া যাবে? মা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, যাতে ইলিশের উৎপাদন বাড়ে। আরও ভেঙে বললে, যাতে ইলিশের সন্তান রক্ষা পায়। আলোচ্য ছবিটির ক্ষেত্রে ইলিশশিশুর সুবিধার জন্য মানবশিশুকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে?
প্রশ্ন আরও আছে, মা ইলিশ ধরা বন্ধ রাখতে যতটা তোড়জোড় করে অভিযান চালানো হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা জারি করার সময় কি ততটা উৎসাহ ছিল? ডিম্ববতী ইলিশ রক্ষায় ২০০৬ সাল থেকে অক্টোবরের শেষার্ধে কাগজে-কলমে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হতো। কিন্তু ইতিমধ্যে তিথি পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় তা কাজে আসছিল না। ফলে নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় অক্টোবরের ৬ থেকে ১৬ তারিখ। অক্টোবরের এক তারিখ মৎস্য অধিদফতর এ সিদ্ধান্ত নেয়। মাত্র পাঁচ দিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন কতটা যৌক্তিক? উচিত ছিল মা ইলিশ রক্ষার কর্মসূচি বাস্তবায়নে বেশ আগে থেকে যথেষ্ট প্রচার চালানো।
এ ধরনের কর্মসূচি মেনে চলার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যও তো জেলেদের আরও সময় দেওয়া দরকার। উপকূলীয় জেলেরা সাধারণত ১০-১৫ দিনের জন্য ইলিশ ধরতে বেরিয়ে যান। যারা ২ তারিখের আগেই জাল-নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন, তারা কীভাবে নিষেধাজ্ঞা মানবেন? এ ধরনের একেকটি ট্রিপে যাওয়ার আগে তারা মহাজনের কাছ থেকে দাদন, ঋণ বা আগাম দাম নিয়ে যান। ফিরে এসে ইলিশ বা অর্থ দিয়ে তা শোধ করেন। যেসব জেলে নিষেধাজ্ঞা জারির আগেই মাছ ধরতে গেছেন, তারা ঋণ শোধ করবেন কীভাবে? ওই দশদিন দিন এনে দিন খাওয়া জেলেদের সংসার চলবে কীভাবে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারির আগে এটাও বিবেচনা করা উচিত নয় কি? নাকি প্রশাসন কেবল কিল মারার গোঁসাই?
ইলিশ সুরক্ষা কার্যক্রম অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য; কিন্তু তারও আগে ভাবতে হবে জেলেদের সুরক্ষার কথা।
 

No comments

Powered by Blogger.