রোডমার্চ-রাজনৈতিক বিকল্প কি মিলবে? by সুভাষ সাহা

খালেদা জিয়াকে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। আবার এখন রাজনীতিতে হুট করে অগণতান্ত্রিক শক্তির আবির্ভাব ঘটা প্রায় দুরূহ, বিশেষত বাংলাদেশের বেলায়। কেবল রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের চরম ব্যর্থতার কারণেই এমনটা ঘটতে পারে। আমরা কি মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের সামরিক ও একনায়কত্ববাদী শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে এক ধরনের গণতন্ত্র চর্চা দেখতে পাচ্ছি না! সুকুমার রায় 'নারদ নারদ' ছড়ায় অহেতুক বচসার এক অনন্য চিত্র


এঁকেছিলেন। তবে ধুন্ধুমার ওই কলহপ্রিয়তার অবসান ঘটেছিল প্রাণ-আকুল করা সন্ধি প্রস্তাবে :ভেরি ভেরি সরি মসলা খাবি? খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় জোটের রোডমার্চ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষে চটাংচটাং কথার বুদ্বুদ ছড়ানোর পরও কর্মসূচির সূচনায় সরকার এবং বিরোধীপক্ষের সংযম ও ধৈর্যের পারঙ্গমতা প্রদর্শন দেখে সুকুমার রায়ের নারদ নারদ ছড়ার মতো তাদের মধ্যে তলে তলে সন্ধি হয়ে গেছে কিনা_ এ নিয়ে কারও কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে।
বিরোধী দলের ঢাকা থেকে সিলেট অভিমুখী রোডমার্চ শেষ পর্যন্ত কোনো বাধাবিঘ্ন ছাড়াই মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় গন্তব্যে পেঁৗছে যায়। গাড়ি মিছিলের বিরাট কাফেলার দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিলেট পেঁৗছানোর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন রোডমার্চ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী কাফেলাকে পূণ নিরাপত্তা দিয়েছিল। বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও দীর্ঘ পথযাত্রায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দেওয়া হয়নি। হরহামেশা যেটা করা হয় :সেই ভাংচুর, ইচ্ছাকৃতভাবে সড়কে চলাচলে বাধা দেওয়া ইত্যাদি অনিষ্ট সাধনের মতো কর্মগুলো সচেতনভাবেই পরিহার করা হয়েছে। এ থেকেই সরকার এবং বিরোধীপক্ষ অন্তত রোডমার্চ অনুষ্ঠানের সূচনা দিনে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে বলা যায়। রোডমার্চের পুরো কর্মসূচিতেই যেন এ ধরনের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় থাকে_ এই চাওয়াটা নিশ্চয়ই অতিশয়োক্তি হবে না!
তবে খালেদা জিয়া রোডমার্চের সময় দেওয়া বক্তব্যে এবারও সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করেছেন দেখে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। অতীতে নির্বাচনের সময় তিনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের মসজিদগুলোতে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে বলে সরাসরি সাম্প্রদায়িক উক্তি করেছিলেন। এভাবে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করা হলে, বিশেষ করে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও নেতা-নেত্রীরা যদি তাতে প্রত্যক্ষভাবে মদদ দেন, তাহলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ফকফকা হতে বেশি সময় লাগবে না। আমরা এক সময় যে দেশের বাসিন্দা ছিলাম সেই সোনার পাকিস্তানে ইসলামী হুকুমত কায়েম করা এবং মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদকে আশকারা দিতে গিয়ে কী দশা হয়েছে তা তো এ দেশের আমজনতার কাছেও আজ আর অজ্ঞাত নয়। তারপরও খালেদা জিয়া কী করে এভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করেন, তা বোধগম্য নয়।
তাছাড়া, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার জন্য কুখ্যাত জামায়াতে ইসলামীকে কী করে এবারও তার সঙ্গী করলেন, সে হিসাব মেলাতে গিয়ে অনেকেই গলদ্ঘর্ম হচ্ছেন। বিএনপি যদি সংসদে নিয়মিত যেত এবং তারা যদি এবারের রোডমার্চের মতো শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করত তাহলে মানুষ এমনিতেই সরকার ব্যর্থ হলে তাদের ক্ষমতায় আনার কথা ভাবতে পারত। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গী করে এবং গ্রেফতারকৃত ও বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দাবি করে তিনি গণদাবির প্রতি প্রকারান্তরে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করলেন। তার এই পদক্ষেপের মাধ্যমে এক সময়ের ঘৃণিত রাজাকার-আলবদর-আলশামসরা আশকারা পেতে পারে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর সামরিক শাসক-মৌলবাদী শক্তির যে জোট গড়ে ওঠে তার জোরেই এরা এতদিন ধরাকে সরা জ্ঞান করে আসছিল। যেভাবে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা দীর্ঘদিন বুক ফুলিয়ে হেঁটেছে, সেই একইভাবে এরাও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেও এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা পার পায়নি। চার নেতার খুনিরাও পার পাবে না। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর বিচার কি কেউ আটকাতে পারবে? মনে হয় না। এসব কর্মকাণ্ড যারা লালন-পালন করে তাদের পেলা দিতে এ মুহূর্তে কোনো মুরুবি্ব পাওয়া যাবে না। সুতরাং খুঁটির জোর না থাকলে ভেড়া কুঁদবে কার জোরে!
খালেদা জিয়াকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। আবার এখন রাজনীতিতে হুট করে অগণতান্ত্রিক শক্তির আবির্ভাব ঘটা প্রায় দুরূহ, বিশেষত বাংলাদেশের বেলায়। কেবল রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের চরম ব্যর্থতার কারণেই এমনটা ঘটতে পারে। আমরা কি মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের সামরিক ও একনায়কত্ববাদী শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে এক ধরনের গণতন্ত্র চর্চা দেখতে পাচ্ছি না! পাকিস্তানে ভয়াবহ সংকট সত্ত্ব্বেও সে দেশের সেনাবাহিনী কি শাসন ক্ষমতা কব্জা করার চিন্তা করতে পারে এ মুহূর্তে? আসলে এখন দুনিয়ায় সিকিউরিটি পারসপেকটিভটাই পাল্টে গেছে। তাই ক্ষমতাসীনরা বড় ধরনের ভুল না করলে এ দেশে আর অগণতান্ত্রিক শাসনের আগমন ঘটা দুরূহ।
দেশে এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বর্গতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, দুর্নীতি-চাঁদাবাজি ইত্যাদি ঘটনার কারণে মানুষ ক্ষমতাসীনদের ওপর ক্ষুব্ধ। কিন্তু বিরোধী দলের দেশ শাসনের অতীত ব্যর্থতার রেকর্ড এবং বর্তমানে তাদের মৌলবাদ ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার ঘটনা জনগণ স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু এ অবস্থায় জনতার সামনে বিকল্প নিশ্চয়ই মন্দের ভালো হিসেবে অগণতান্ত্রিক শাসনও নয়।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির উচিত জনগণের সামনে বর্তমান সময়োপযোগী প্রকৃত রাজনৈতিক বিকল্প হয়ে ওঠা। তিনি কেন বুঝতে চাইছেন না যে, তার স্বামী জিয়াউর রহমান যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতার মাধ্যমে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বিকাশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং এখন এর পক্ষে বেগ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে, তাকে উপেক্ষা করে এ অঞ্চলের কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই আর রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়। জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িতা পরিত্যাজ্য।
গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে সংসদকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে হয়। সরকারি দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের নিয়েই সংসদ। বিরোধী দল যদি স্থায়ীভাবে সংসদে না যায় তাহলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদ তার কার্যকারিতা হারায়। আমাদের দেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস হচ্ছে, যারা বিরোধী দলে থাকেন তারা নানা ছুতানাতায় সংসদ বর্জনকে স্থায়ী রূপ দিয়ে ফেলেন। রাস্তার আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এভাবে এ দেশের সংসদ গণতান্ত্রিক সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালনে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির কি উচিত নয় সংসদে ফিরে যাওয়া এবং এ প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যকরী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করা?
বিশ্বখ্যাত নাট্যকার ব্রেখট বলেছেন, কারও সঙ্গে কথা হলে সে যখন বলে, 'ও ব্রেখট, তুমি তো একটুও পাল্টাওনি।' তখন আঁতকে উঠে বলেছি, 'পাল্টাইনি মানে? তার মানে হয়তো আমার কোর্টটা পাল্টায়নি, চুরুটের ব্র্যান্ড বদল হয়নি, চেয়ারে বসে মুচকি হাসিটা বদলে যায়নি। কিন্তু ভাবনা-চিন্তায় পাল্টাইনি মানে তো মরে গেছি।' আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা, ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটাতে হয়। বর্তমান বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে খালেদা জিয়া যদি তার নিজের ও দলের রাজনৈতিক চিন্তায় সময়োপযোগী পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হন তাহলে আওয়ামী লীগের বিকল্প রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তার উপযোগিতা হারাবে এবং এক সময় শুকিয়ে মরবে। কেবল রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নয়, রাজনৈতিক চিন্তায় পরিবর্তন আনয়ন এখন সময়ের দাবি।

সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.