স্মৃতি তার অমলিন by আতিকুল হক চৌধুরী

কজন আলোকিত সাংবাদিক, একজন আলোকিত মানুষের নাম ওবায়েদ উল হক। এ পৃথিবীতে এসেছিলেন ১৯১১ সালের ৩১ অক্টোবর ফেনীতে আর চলে গেলেন ২০০৭ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকাতে। ওবায়েদ উল হক ১৯৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। আইন পাস করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৪৬ সালে হিমাদ্রী চৌধুরী নামে কলকাতায় নিজের লেখা একটি বাংলা ছবি পরিচালনা করেন 'দুঃখে যাদের জীবন গড়া'।


কলকাতায় আমি ছবিটি দেখেছিলাম। ওবায়েদ উল হকই হচ্ছেন প্রথম বাঙালি মুসলমান, যিনি এ রকম একটি পরিচ্ছন্ন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছবি উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার নিজের লেখা নাটক 'চোরা বাজার', 'পথের পদাবলী', 'দিক বিজয়ী' ও 'সমাচার এই' ওই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। 'সায়াহ্নের সংলাপ' নামেও তিনি একটি মঞ্চনাটক রচনা করেছিলেন। তার অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মঞ্চনাটক 'এই পার্কে' বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল। ষাটের দশকে ঢাকায় 'দুই দিগন্ত' ও 'অন্তরঙ্গ' নামে তিনি দুটি ছবি নির্মাণ করেন। তার রচিত আরেকটি ছবি 'আজান', যার পরিচালক ছিলেন বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগরের স্বনামধন্য বাবা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফজলুল হক। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৫১ সালে তিনি তখনকার পাকিস্তান অবজারভার, ইংরেজি পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। যুগ্ম সম্পাদক, তারপর সম্পাদক পদে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সংযুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ অবজারভারে। বেঁচে থাকার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমার সঙ্গে তার পরিচয় সেই ষাটের দশকে, যখন আমি তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের একজন প্রডিউসার ছিলাম। বেতার ও পরবর্তী পর্যায়ে টেলিভিশনে তার রচিত অগণিত নাটক প্রযোজনার সুযোগও হয়েছিল আমার। বিটিভিতে তার লেখা, 'সূর্য্যের ঠিকানা', 'নির্জন দ্বীপ, 'শেষ নেই', 'দ্বৈত সঙ্গীত', 'ওপরে ওঠার সিঁড়ি', 'নতুন খবর', 'আবহাওয়ার পূর্বাভাস' অত্যন্ত দর্শকনন্দিত নাটক ছিল। তাকে বরাবরই আমি একজন সমাজসচেতন নাট্যকার হিসেবে শ্রদ্ধা করতাম। বয়সে তিনি আমার চেয়ে অনেক বড় হলেও, মানুষ হিসেবে অনেক উঁচুমাপের মানুষ হলেও তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। তিনি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না; কিন্তু সুস্থ রাজনীতিসম্পন্ন অভিজ্ঞ ও সচেতন মানুষ ছিলেন অবশ্যই। ধর্মান্ধ নয়, ধর্মসচেতন ছিলেন একনিষ্ঠভাবে। মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন সাম্প্রদায়িকতা ও সব ধরনের কুসংস্কারকে। কাউকে অযথা তোষামোদ করা, তুষ্টি করা তার স্বভাবের বাইরে ছিল। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে তিনি নিন্দাও করতে পারতেন না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ অনুসরণ করে নানা প্রতিকূল সময় ও পরিবেশেও তিনি একজন সাহসী ও বলিষ্ঠ সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। সূর্যের মতো তিনি আলো ছড়িয়ে গেছেন আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে। ৯৭ বছর বয়সেও মনটা ছিল তার চিরসবুজ, তারুণ্যে ভরা, যদিও বাইরে থেকে তাকে মনে হতো রাশভারী একজন গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ বুঝি। তার তেমন উল্লাস ছিল না, উচ্ছ্বাসও ছিল না, কিন্তু মনটা ছিল তার জীবন উৎসাহে ও উদ্দীপনায় ভরপুর। পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন একজন স্নেহময় পিতা, যত্নবান স্বামী ও সবার গ্রহণযোগ্য, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও শ্রদ্ধাভাজন একজন অগ্রজ। আচার-আচরণে, আপ্যায়নে, বলনে-চলনে তিনি ছিলেন যাকে বলে একজন 'পারফেক্ট জেন্টেলম্যান'। এ সময়ে এই জেন্টেলম্যানদের এখন বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তিনি কাউকে প্রতিযোগী ভাবতেন না, প্রতিদ্বন্দ্বীও ভাবতেন না; ভাবতেন সবাই তার সহযোগী ও সহযাত্রী। তবে পথের ঠিকানা ঠিকই জানা ছিল তার। আর সে পথেই থেকেছেন শেষ পর্যন্ত। আজ যখন সমাজে কেউ কারও জন্য এতটুকু স্পেস ছেড়ে দিতে রাজি নন, সাধারণ সৌজন্য বোধটুকুও যেখানে আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ওবায়েদ উল হকের মতো সজ্জন মানুষের কথা খুব মনে পড়ে, বিশেষভাবেই মনে পড়ে। আজ তার প্রয়াণ দিবসে তাকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধা ও আন্তরিক ভালোবাসায়। কামনা করছি তার বিদেহী আত্মার অপার শান্তি।

আতিকুল হক চৌধুরী : নাট্যকার
ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.