স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৭১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।ওয়াজিউল্লাহ, বীর প্রতীক আম্রকাননে বীরের লড়াই সীমান্ত এলাকায় টহল দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে এক আমবাগানে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ঢুকেছেন ওয়াজিউল্লাহ ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা। এমন সময় তাঁরা আক্রান্ত হলেন। পাকিস্তানি সেনারা অতর্কিতে আক্রমণ করল। ব্যাপক গুলিবৃষ্টির মধ্যে তাঁরা একটুর জন্য বেঁচে গেলেন। যে যেভাবে পারলেন নিরাপদ স্থানে আশ্রয়


নিলেন। ওয়াজিউল্লাহ আশ্রয় নিলেন একটি মোটা গাছের আড়ালে। গাছের গা ঘেঁষে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। গুলির শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত। গাছের পাতা ঝড়ে পড়ছে। সহযোদ্ধারা কে কোথায় ওয়াজিউল্লাহ জানেন না। পাল্টা গুলির শব্দও পাচ্ছেন না। তিনি বিচলিত না হয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন, কোন দিক থেকে গুলি হচ্ছে। কিন্তু অবস্থান চিহ্নিত করেও পাল্টা আক্রমণ চালাতে পারছেন না। গাছের আশপাশ দিয়ে সমানে গুলি ছুটে যাচ্ছে। কয়েকটি গুলি তাঁর নিজের গা ঘেঁষে গেছে। একটু নড়াচড়া করলেই নিশ্চিত মৃত্যু। তারপরও ওয়াজিউল্লাহ ভাবলেন, কিছু একটা করতে হবে। মরতে যদি হয়ই, বীরের মতো লড়াই করেই মরবেন। একটু পর অনেক কষ্টে গাছের গোড়ায় অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান লক্ষ করে একাই পাল্টা আক্রমণ চালালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের দিক থেকে গোলাগুলি কমতে থাকল। এতে তাঁর সাহস আরও বেড়ে গেল। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের কোনো একদিন (সঠিক তারিখ এখন তাঁর মনে নেই)। মুজিবনগর আম্রকাননে।
মুজিবনগর মেহেরপুর জেলার (১৯৭১ সালে মহকুমা) অন্তর্গত। বর্তমানে উপজেলা। জেলা সদর থেকে দক্ষিণে। তখন এই জায়গার নাম ছিল বৈদ্যনাথতলা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের প্রধান ঘাঁটি ছিল মেহেরপুরে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি ছিল মুজিবনগরে। পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই মুজিবনগরের আম্রকুঞ্জে হামলা চালাত। সেদিন বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা মুজিবনগরে টহলে এসে কিছু থেকে যায়। তারা আমবাগানে ওত পেতে ছিল। ওয়াজিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষুদ্র টহল দল সে খবর জানতেন না। টেরও পাননি তাঁরা দূরবর্তী এলাকায় টহল দিয়ে আম্রকাননে প্রবেশ করামাত্র পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আক্রান্ত হন। পরে তিনি একাই সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। তাঁর বীরত্বে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফলে বেঁচে যান তাঁর সহযোদ্ধারা।
ওয়াজিউল্লাহ চাকরি করতেন ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বিডিআর, এখন বিজিবি)। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইংয়ের অধীনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ৮ নম্বর সেক্টরের লালবাজার সাবসেক্টরে। এই সাবসেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। মুজিবনগর, সোনাপুর, ভবেরপাড়া, বল্লভপুর, বাগোয়ানসহ আরও কয়েক স্থানে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। একবার পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল মুজিবনগরের পার্শ্ববর্তী বল্লভপুরে মিশনারি চার্চে হামলা করে। তখন ওয়াজিউল্লাহ কয়েকজন সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই দলের ওপর সাহসিকতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালান। অনেকক্ষণ ধরে যুদ্ধ হয়, এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরে তারা পালিয়ে যায়। ওই যুদ্ধের খবর তখন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য ওয়াজিউল্লাহকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২০৩।
ওয়াজিউল্লাহর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা ইউনিয়নের বজরা গ্রামে (মুহুরি বাড়ি)। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে এখানেই বসবাস করছেন। তাঁর বাবার নাম নূর আলী। মা হাসমতের নেছা। স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। তাঁর চার ছেলে দুই মেয়ে। ওয়াজিউল্লাহ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান। তাঁর বয়স প্রায় ৮২ বছর। এখনো শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। চলাফেলা করতে পারেন। এলাকাবাসী খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে চেনেন।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.