আটক অর্ধশত : পুলিশ কমিশনার প্রত্যাহার

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শফিউল ইসলাম লিলন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। ফলে সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগে ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। এদিকে শনিবার রাতে ২০ জনকে আটকের পর রোববার রাতভর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরও ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে। এ নিয়ে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ৫০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। নগরীর মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে জানান, ড. শফিউলের হত্যাকারীদের আটক করতে একসঙ্গে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, মতিহার থানা পুলিশসহ বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে। রোববার বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মির্জাপুরের রিমা ছাত্রাবাস থেকে ৫ শিক্ষার্থীসহ রাতে অভিযান চালিয়ে বিনোদপুর, মির্জাপুর, কাটাখালী, চৌদ্দপাইসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষসহ ১১ জনকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
ওসি আরও বলেন, তদন্তের স্বার্থে এখন আটককৃত কারও নাম-পরিচয় প্রকাশ করা যাচ্ছে না। আটককৃতদের মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আটকের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত বলে জানান তিনি।
গত শনিবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নাইমুল ও টিপু নামের দু’জনকে আটক করেছে মতিহার থানা পুলিশ। পরদিন রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান চালায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা নগরীর ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ূন আহম্মেদসহ ২০ জনকে আটক করে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রীও রয়েছেন।
দ্বিতীয় দিন ক্লাস-পরীক্ষা শিক্ষকদের বর্জন : এদিকে হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালন করেছে শিক্ষক সমিতি। ফলে রোববারের মতো আজ সোমবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগে ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। মঙ্গলবার পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক প্রণব কুমার।
শিক্ষক সমিতির মানববন্ধন : সোমবার সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভবনের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে শিক্ষক সমিতি। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন। পূর্বঘোষিত এই কর্মসূচিতে শিক্ষক সমিতির নেতাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা বক্তব্য দেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি কামরুল ইসলাম মজুমদার যুগান্তরকে জানান, ‘অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য আমরা প্রশাসনকে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছি। এই সময়ের মধ্যে যদি খুনিদের চিহ্নিত করে বিচার করা না হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি আরও কঠোর কর্মসূচি দেবে বলেও জানান তিনি।’
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মানববন্ধন : সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের উদ্যোগে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি একাÍতা ঘোষণা করেছে। মানববন্ধনে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অংশ নেন।
ছাত্রলীগের ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ : এদিকে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ছাত্রলীগের সভাপতির নেতৃত্বে ২০ মিনিট অবরোধ করে নেতাকর্মীরা। পরে তারা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে এসে কর্মসূচি শেষ করে।
চলছে গণগ্রেফতার : ঘটনার কোনো ক্লু এখনও পর্যন্ত উদঘাটন করতে না পারলেও বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মেস ও বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে ঢালাওভাবে আটক করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে মতিহার থানার ওসি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই অভিযান চালাচ্ছি। সন্দেহভাজনদের আটক করে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কাউকে হয়রানি করার জন্য পুলিশ কাজ করছে না।’
পুলিশ কমিশনার প্রত্যাহার : প্রফেসর ড. একেএম শফিউল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দ্বিতীয় দিনের মাথায় রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার ব্যারিস্টার মাহাবুবুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। নতুন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. শামসুদ্দিনকে। সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়। এ আদেশে ব্যারিস্টার মাহাবুবুর রহমানকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
আরএমপির কমিশনার বদলির নেপথ্যে : ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান আরএমপিতে যোগদান করেন গত বছরের ২১ অক্টোবর। এক বছরের বেশি সময় তিনি আরএমপির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বিরুদ্ধে শিবির তোষণের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০ থেকে ১২ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন শিবির ক্যাডারদের হামলায়। এদের মধ্যে সাদ্দাম ও বাবু পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। শিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থান পোক্ত করে তার আমলেই। এছাড়া নগরীতে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়সহ সার্বিক আইনশৃংখলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে তার সময়ে।
ছাত্রলীগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান সুমন যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রলীগের এসব নেতাকর্মীর ওপর হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন। ইমন ২৪ ঘণ্টা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকাতে ঘোরাফেরা করলেও তাকে গ্রেফতার করা হয় না।
রাজশাহীর আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে রোববার দুপুরে দেখা করেন রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। সাক্ষাৎকালে ড. শফিউল ইসলাম হত্যাকাণ্ডসহ সার্বিক আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেন। ক্যাম্পাসে জামায়াত-শিবিরের জঙ্গি তৎপরতা, কিলিং মিশন, বোমা হামলা, রগকাটার রাজনীতি সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রীকে অবহিত করেন। বাদশা আরএমপি কমিশনারের ভূমিকা নিয়ে তার অসন্তোষের কথা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে জানান। আর এর পরপরই পুলিশ কমিশনারের বদলির আদেশ আসে।
১১ জনকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন : আটককৃতদের মধ্য থেকে ১১ জনকে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তারা সবাই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও ১৬ জনকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং তিনজনকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.