জিএসপি সুবিধা এবং বাংলাদেশের শিল্প খাত by ড. হারুন রশীদ

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্তি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার এ সংক্রান্ত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই বিতর্কের সূত্রপাত। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে এক পয়সাও শুল্ক দেয় না। ওই শুল্ক তাদের দেশের (যুক্তরাষ্ট্রের) ক্রেতা পক্ষান্তরে ভোক্তারাই পরিশোধ করেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ বক্তব্য সঠিক নয় বলে তা নাকচ করে দিয়েছেন। বুধবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ ইনডেনটিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত আইএসও সনদপ্রাপ্তি এবং মেডিয়েশন সেন্টার স্থাপন সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় শুল্ক প্রদান করেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করে। এজন্য বাংলাদেশ পণ্যের মূল্য কম পাচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনেক উন্নত দেশ বাংলাদেশকে ডিউটি ফ্রি ও কোটা ফ্রি প্রবেশাধিকার দিলেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তা দিচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ১৬ শর্ত পূরণ করা হয়েছে এমন দাবি করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, শর্তের কিছু বিষয় বাস্তবায়ন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, সেক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাজ চলছে।
আশির দশকে বাসাবাড়িতে ছোট পরিসরে যে পোশাকশিল্পের সূচনা হয়েছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেটিই এখন সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিচ্ছে। তৈরি পোশাক রফতানিতে চীনের পর বাংলাদেশই হচ্ছে বৃহত্তম দেশ। পাঁচ হাজারেরও বেশি কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে এখানে। একথা ঠিক, বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের উন্নতি হলেও সে তুলনায় বাড়েনি শ্রমিকের জীবনমান ও নিরাপত্তা। একের পর এক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের জীবন যাচ্ছে অকাতরে। এর ফলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিয়ে বিশ্বে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি (অগ্রাধিকারমূলক বাজার ব্যবস্থা) স্থগিত হয়েছে। নানা শর্ত দিচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোও।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, অধিকাংশ শিল্প ও সার্ভিস প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণের পর এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নানা অসুবিধা দেখা দেয়। এসব সমস্যা নিরসনে সে সময়ের শ্রমমন্ত্রী জহুর আহমেদ চৌধুরী দেশে প্রথম শ্রমনীতি ঘোষণা করেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রগতির লক্ষ্যে শিল্পে শান্তি বজায় রাখাই ছিল এ নীতির মূল উদ্দেশ্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিল্প খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে দেশে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। এর মধ্যে গার্মেন্ট খাতেই শ্রমিক রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ। কিন্তু বিদ্যমান শ্রমনীতিতে শ্রমিকদের এসব ব্যাপারে সুষ্ঠু দিকনির্দেশনা না থাকায় তাদের পরিচালনায় নানা সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। একটা কথা সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে, শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ছাড়া শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। এজন্য শ্রমনীতির যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। একবিংশ শতাব্দীতে শিল্পের চরম উৎকর্ষের যুগে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হবে এটাই স্বাভাবিক।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শর্তের বেড়াজালে আটকাতে চাচ্ছে। এ কথা ঠিক, জনসংখ্যাধিক্যের এ দেশে সস্তা শ্রমের কারণেই বিদেশী বায়াররা আমাদের পোশাকশিল্পের দিকে ঝুঁকেছেন। এ কারণেই চীনের পর বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় পোশাক রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে সব পক্ষকেই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যার যে দায়িত্ব সেটি পালন করতে হবে নিষ্ঠার সঙ্গে। শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের ব্যাপারে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের দায়িত্বও রয়েছে। যখন-তখন কারখানায় ভাংচুর ও ধর্মঘট করার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তাদের। কোনো সমস্যা থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত-সহিংসতাও পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎকে কণ্টকাকীর্ণ করছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল হতে হবে।
আর একটি কথা। যে কোনো কোটা বা বিশেষ সুবিধা চিরকালীন কোনো ব্যবস্থা নয়। এজন্য একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় যাতে টিকে থাকা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। সরকার যে বলছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা স্থগিতের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, সেটিও তাদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা, দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও কাজের নিশ্চয়তা প্রদানের বিধান রেখে জাতীয় শ্রমনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শ্রমনীতিতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ন্যূনতম ১০০ শ্রমিক থাকলেই সেখানে ইউনিয়ন করা যাবে। এছাড়াও বলা হচ্ছে, নয়া নীতি অনুযায়ী পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের বেতনবৈষম্য দূর করা হবে। একই সঙ্গে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি/পুনঃনির্ধারণ এবং গঠনে স্থায়ী মজুরি কমিশন করা হবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের সব শ্রমিককে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচ্যুইটি ও অবসর ভাতা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো মালিক শ্রমিকদের এই সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করলে তারও ব্যবসায়িক সনদ বাতিলের বিধান রাখার কথা বলা হয়েছে। শ্রমনীতিতে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এই নীতি অনুযায়ী সরকার শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ন্যায্য মজুরিপ্রাপ্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। এ লক্ষ্যে নিুতম মজুরির মানদণ্ড নির্ধারণ, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নিয়মিত পর্যালোচনা, শ্রমিকের দক্ষতা ও কাজের সঙ্গে সস্পর্কিত করে বিভিন্ন স্তরের মজুরি নির্ধারণ, নারী-পুরুষ ও দেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে মজুরির সমতা নিশ্চিত করবে সরকার। এগুলো কেবল কাগজে-কলমে কিংবা শ্রমনীতিতে থাকলেই হবে না, বাস্তবেও এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
অন্যদিকে আমদানিকারক দেশগুলোরও অযাচিত শর্তারোপ কাম্য নয়। শুধু অভিযোগ না করে বাংলাদেশের শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা আবার চালু করা উচিত। ইউরোপের বাজারেও শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকা জরুরি। কোনো পক্ষের অনভিপ্রেত আচরণের কারণে বাংলাদেশের শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হোক এটা কাম্য নয়।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.