রাবি শিক্ষক হত্যা : অভিযোগের তীর এক ছাত্রীর দিকে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এ কে এম শফিউল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হতে শুরু করেছে। হত্যার দিন শনিবার বিকেলে ওই শিক্ষকের তালাবন্ধ বাসা থেকে একই বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্রীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। হত্যার আগের রাত থেকেই নিহত শফিউলের বাসায় ওই ছাত্রী অবস্থান করছিলেন। ওই ছাত্রীর কারনেই শিক্ষক হত্যা হতে পারে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ওই ছাত্রীর বাসা গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্চ উপজেলায় প্রধান পাড়া গ্রামে। তিনি তাপসী রাবেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় ওই বিভাগের এক ছাত্রী প্রফেসর শফিউল ইসলামের সাথে দেখা করতে তার বাসায় যান। এসময় ওই বাসায় শিক্ষক ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। এরপর শনিবার সকালে ওই ছাত্রীকে ঘরে রেখেই বাসায় তালা দিয়ে শফিউল ইসলাম বিভাগে যান। বিভাগের প্রয়োজনীয় কাজ শেষে দুপুর আড়াই টার দিকে মোটর সাইকেলে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিহাস এলাকার নিজ বাড়ীর উদ্ধেশ্যে রওয়ানা দেন তিনি। এসময় বাড়ির ১০০ গজ আগে পৌছলে দু’জন অস্ত্রধারী যুবক তার গতিরোধ করে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
অভিযুক্ত ছাত্রীর গ্রামের প্রতিবেশী, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ও পুলিশ জানান, নিহত শফিউল ওই ছাত্রীকে তার নিজ বাসায় তালাবদ্ধ করে রাখার পর ওই ছাত্রী নিজেকে উদ্ধার করার জন্য তার বাড়িতে ফোন করেন। ওই ছাত্রীর মা তার মেয়েকে উদ্ধার করার জন্য মেয়ের সহপাঠিদের ফোনে অনুরোধ করেন। এসময় অভিযুক্ত ছাত্রীও তার ঘনিষ্টজনদের ফোন করে তাকে আটকে রাখার বিষয়টি জানাতে থাকেন।
এদিকে এ ঘটনার পর মেয়েটির মা, বাবা ও তার মামা তাকে উদ্ধার করার জন্য গোবিন্দগঞ্জ থেকে শনিবার দুপুরের দিকে ক্যাম্পাসে ছুটে আসেন। পরিবারের সদস্যরা স্যারের বাসা থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করার জন্য প্রভাবশালী নেতার দারস্থ হন। এর পর বেলা ৩টার দিকে ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফেরার পথে শফিউল সন্ত্রাসীদের হাতে নিহন হয়।
হত্যাকান্ডের পরপরই ডিবি পুলিশের সদস্যরা বাড়িটি ঘিরে ফেলে। কিছুক্ষণ পর তারা ওই বাড়িতে তালা ভেঙে তল্লাশি চালায়। এসময় বাড়ির একটি কক্ষ থেকে ওই ছাত্রীকে আটক করে পুলিশ। তবে তার আটকের ঘটনা গোপন রেখে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশ। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী হত্যার কু উদ্ধারের চেষ্টা করছে তারা।
এ বিষয়ে ঐ ছাত্রীর মায়ের সাথে মুঠোফোনে কথা বললে  তিনি জানান,  আমরা ( ছাত্রীর বাবা, মামা, দুই বোন) মেয়েকে নিতে শনিবার রাজশাহীতে আসি। পরে সন্ধার দিকে ঔ শিক্ষকের বাসার সামনে পুলিশ আমাদের হত্যাকান্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
জানা যায়, মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের মোবাইল ফোনটি আকড়ে ধরে ছিলেন নিহত শিক্ষক অধ্যাপক ড. একেএম শাফিউল ইসলাম। শরীর থেকে অধিক রক্তক্ষরণে যখন তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলেন তখনও বার বার চেয়েও মোবাইলটি হাতে নিতে পারেননি উপস্থিত শিক্ষকরা।
এরপর আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে রক্ত দেয়া হচ্ছিল তখনই হাত থেকে পড়ে মোবাইলটি। এর খানিক পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ড. শফিউল।
পরে ওই মোবাইল ফোনটি হেফাজতে নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক ওমর ফারুক। তিনি পরবর্তীতে লিখিত নিয়ে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করেন।
প্রশ্ন উঠেছে কেন মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ড. শফিউল হাতছাড়া করতে চাননি মোবাইলটি। তবে কি বড় কোনো প্রমাণ লুকিয়ে আছে মোবাইলটিতে? হয়তো তিনি হামলাকারীদের ফোন রেকর্ড করেছিলেন। কিংবা ভিডিও বা এসএমএস (খুদেবার্তা) কিংবা কল নাম্বার সংরতি রেখেছেন। এমন নানা ঘুরপাক খাচ্ছে শিকসহ হত্যার কু অনুসন্ধানে নাম আইন-শৃঙ্খলাবাহীর সদস্যদের মধ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষক বলেন, স্যারের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি হতে পারে হত্যাকান্তের রহস্য উদঘাটনের বড় ‘কু’। হামলার পর থেকে জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত স্যার তার মোবাইল ফোনটি হাতছাড়া করেননি। তিনি মনে করেন, পুলিশ যখন কোনো কারণ উদ্ধার করতে পারছে না তখন নিহতের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিই হতে পারে বড় কু।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপপরিদর্শক (ওসি) আব্দুল মজিদ বলেন, সাক্ষী হিসেবে একটি মোবাইল ফোন পেয়েছি। সেটি নিয়ে আমরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। তিনটি বিষয় নিয়ে আমরা সামনে এগুচ্ছি। তবে এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়াও হত্যাকাণ্ডের পরে নিহত শফিউলের বাসা থেকে উদ্ধারকৃত সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীর প্রেমিক জাহাঙ্গীর জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আটককৃত ছাত্রীর প্রেমিক একই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। নিহত ড. শফিউলের সাথে জাহাঙ্গীরের সুুম্পর্ক ছিল। জাহাঙ্গীরের মাধ্যেমেই স্যারের সাথে পরিচিত হন ওই ছাত্রী। পরে স্যারের সাথে ছাত্রীর গভীর  সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং প্রেমিক জাহাঙ্গীরকে এড়িয়ে চলতে থাকে। পরে আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্কে অবনতি ঘটে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা মনে করেন, প্রতিশোধ নিতে প্রেমিক জাহাঙ্গীর এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে।
সার্বিক বিষয়ে নগরীর মতিহার থানার কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর বলেন, ওই ছাত্রীকে আটকের পর গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মজিদ বলেন, তদন্তের স্বার্থে এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। পরবর্তীতে আপনাদের জানানো হবে।
প্রসঙ্গত, শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড.একেএম শফিউল ইসলাম। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। এ হত্যার ঘটনায় রোববার রাবি রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. এন্তাজুল হক বাদী হয়ে অজ্ঞতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
উত্তাল ক্যাম্পাস
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড.একেএম শফিউল ইসলাম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ও জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। সোমবার দ্বিতীয় দিনের মত কাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। ফলে এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিভাগে কাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। আজ মঙ্গলবারও কাস-পরীক্ষা বর্জনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
এদিকে এ ঘটনার জড়িত সন্দেহে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরও ২৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এনিয়ে এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় মোট আটকের সংখ্যা হলো প্রায় অর্ধশতাধিক।

No comments

Powered by Blogger.