বধির সংস্থার জমি এক দশক ধরে বেদখলে

শ্রবণপ্রতিবন্ধী (বধির) সংস্থার এক একর জমি প্রায় এক দশক ধরে বেদখল হয়ে আছে। দখলকৃত ওই জমিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য বধির কমপ্লেক্স তৈরি করার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে ওই জমিতে পুরান ঢাকার একজন সংসদ সদস্যের মালিকানাধীন একটি তেলের পাম্প রয়েছে।
এদিকে রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় বধির সংস্থার মূল ভবনের বেজমেন্টটি প্রায় তিন দশক ধরে বেদখল ছিল। সম্প্রতি হাইকোর্টের রায়ে সেটি দখলমুক্ত করা হয়। এ অবস্থায় বধির সংস্থার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে চুরির মামলাসহ নানা ধরনের মামলা দিয়ে হয়রানি করছে দখলদাররা। সংশ্লিষ্টরা এসব অভিযোগ করেছেন।
কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, লালবাগ থানার মৌজাধীন এসএ রেকর্ডের ২০৬৫নং দাগের অংশে এক একর অকৃষি খাসজমি ২০০৫ সালে বধির হাইস্কুলের অনুকূলে বরাদ্দ দেয় সরকার। পাঁচ লাখ টাকা প্রতীকী মূল্যে এ বরাদ্দ দেয়া হয়। টাকা জমা দেয়ার পর ওই জমি থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর বধির সংস্থাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। এখানে প্রস্তুাবিত বধির কমপ্লেক্স তৈরি করার কথা রয়েছে। জমিটি বুঝিয়ে দেয়ার কিছুদিন পরেই তা বেদখল হয়ে যায়। ২০০৭ সালে সরকার আবারও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে বধির সংস্থাকে জমিটি বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু তারপর আবারও বেদখল হয়ে যায়। এরপর থেকে জমিটি ফিরে পেতে বধিররা মানববন্ধনসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছেন। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।
জাতীয় বধির সংস্থার সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার জানান, জমিটি রেজিস্ট্রি দলিলমূলে বধির সংস্থাকে ৯৯ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রদান করে সরকার। এরপর বধির সংস্থাকে এই জমির দখলও বুঝিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু দখল বুঝে পাওয়ার কিছুদিন পরেই এই জমি বেদখল করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা হাজী মোহাম্মদ সেলিম। বর্তমানে তিনি স্বতন্ত্র এমপি।
তিনি আরও বলেন, রাজধানীর বিজয়নগরে অবস্থিত বধির হাইস্কুলের কয়েকটি কর্মসূচিতে এসেছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন। তারা সবাই কর্মসূচিতে দেয়া বক্তব্যে বধিরদের জমি উদ্ধারের প্রতিশ্র“তি দিয়ে যান। কিন্তু পরে তারা কেউই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননি।
জাতীয় বধির সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ লিখিত বক্তব্যে জানান, আমরা বধির। কথা বলতে পারি না। আমরা প্রতিবাদ করতে পারি না। আমরা দুর্বল। তাই সাংবাদিকদের মাধ্যমে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরতে চাই। আমরা জমি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই। প্রশাসনের সহযোগিতা চাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাজী মোহাম্মদ সেলিম বলেন, জমিটি আমার পৈতৃক সম্পত্তি। ওয়ার্ড কমিশনার হওয়ার আগে থেকেই এ জমি আমার। ১২ বছর আগে জমিটি নাসির উদ্দিন পিন্টু খাসজমি দেখিয়ে ডিসিকে দিয়ে বধির সংস্থাকে লিখিয়ে দেন। র‌্যাব দিয়ে তখন আমাকে উচ্ছেদ করেছিল। তিনি আরও বলেন, বধির সংস্থার স্কুলের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জমিটির উদ্বোধনও করেছিলেন। যেহেতু জায়গাটি আমার, তাই পরে আমি জায়গাটি দখলে নেই। তবে বর্তমানে এ জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে বলেও জানান স্বতন্ত্র এ এমপি।
বধির সংস্থার ভবনের বেজমেন্ট বেদখল : মামলার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ৬২, বিজয়নগরে অবস্থিত বধির সংস্থার মূল ভবনের (বেজমেন্ট) নিচতলা ভাড়া দেয়ার জন্য ১৯৮৬ সালে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। যার সর্বোচ্চ ভাড়াদাতা ছিলেন মেসার্স আবেদীন অ্যান্ড কোম্পানি। পরে কোম্পানিটি একই বছরে বধির সংস্থার সঙ্গে ২০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি করে। চুক্তিতে বলা হয়, এ বেজমেন্টে কোম্পানিটি তার নিজ খরচে একটি কেন্দ্রীয় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক মার্কেট নির্মাণ করবে। নির্মাণকাজ দুবছরের মধ্যে শেষ করার কথা।
চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানিটি নিজ খরচে মার্কেট নির্মাণ করার কারণে ১২ বছর বেজমেন্টের কোনো ভাড়া দেয়া লাগবে না। পরবর্তী সময়ে ১০ বছরের জন্য প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা করে ভাড়া দিতে হবে। এই ১০ বছর পার হওয়ার পরে পরবর্তী ১০ বছরে প্রতিবছর আড়াই হাজার টাকা করে এ ভাড়া বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু চুক্তির পর কোম্পানিটি ওই মার্কেট নির্মাণ করেনি। চুক্তি ভঙ্গ করেও বিনা ভাড়ায় ১২ বছর পার করেছে। উপরন্তু গোডাউন বানিয়ে তা অন্যের কাছে ভাড়া দিয়েছে। পরে যে হারে ভাড়া দেয়ার কথা ছিল তাও দেয়নি। এরপর চুক্তি ভঙ্গের জন্য উচ্ছেদের নোটিশ দেয় বধির সংস্থা কর্তৃপক্ষ।
এই উচ্ছেদ নোটিশ চ্যালেঞ্জ করে কোম্পানিটি প্রথমে নিু আদালতে মামলা করে। নিু আদালতে হেরে যাওয়ার পর আপিল করলে চলতি বছর হাইকোর্টেও হেরে যায়। আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে বলা হয়েছে, আবেদনকারী ইতিমধ্যে ভাড়াখেলাপি বলে বিবেচিত হয়েছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের রায় ঘোষণার দিন বিকালেই বধির সংস্থার সভাপতি আডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারের বিরুদ্ধে ওই বেজমেন্ট থেকে জিনিসপত্র চুরির অভিযোগে মামলা করেন কোম্পানিটির মালিক দাবিদার সৈয়দ রুহুল আরেফীন। পরে ওই মামলায় তাকে কারাগারেও পাঠায় পুলিশ। তৈমুর আলম খন্দকার বর্তমানে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এ ব্যাপারে তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, আবেদীন অ্যান্ড কোম্পানির মূল মালিক মারা গেছেন। এরপর প্রমাণপত্রবিহীন এক আম মোক্তার এসে হাজির হন। তিনি চুক্তি ভঙ্গ করে বিনা ভাড়ায় ১২ বছর কাটিয়েছেন। তারপর ভাড়া দেয়ার কথা থাকলেও তা দেননি।

No comments

Powered by Blogger.