জিএসপি ছাড়া টিকফা অকার্যকর : বাণিজ্যমন্ত্রী

ব্যবসায়িক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্যই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তি করেছে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি (অগ্রাধিকারমূলক বাজার প্রবেশাধিকার) সুবিধা না দিতে চায়- তাহলে দুই দেশের মধ্যকার টিকফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক) চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হতে দেশটির বাজারে জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্তি জরুরি উল্লেখ করে এজন্য তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সার্বিক সহযোগিতাও চেয়েছেন।
অপরদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা এ প্রসঙ্গে আবারও পরামর্শ রেখে বলেছেন, রফতানি বাড়াতে বাংলাদেশের কারখানাগুলোর কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য কর্মস্থলের নিরাপত্তা, শ্রমিক অধিকার রক্ষা ও পরিবেশ রক্ষায় আন্তর্জাতিক মান অর্জন জরুরি। এ সময় বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকারকেই সর্বাত্মক ভূমিকা রাখতে হবে। দেশে উন্নত আইনের শাসন নিশ্চিত, আমলতান্ত্রিক জটিলতা ও লালফিতার দৌরাত্ম্য দূর এবং দুর্নীতি কমানো গেলে বিনিয়োগ বাড়বে। তবে এজন্য সরকারকে রাজনীতিতে ঝুঁকি কমিয়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।
সোমবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ইউএস ট্রেড শো-২০১৪ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তারা প্রধান ও বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এসব মন্তব্য করেন। যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদিত পণ্য, ব্যাংক ও আর্থিক সেবা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি, প্রসাধনী ও ভোগ্যপণ্য নিয়ে ৩ দিনব্যাপী এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) ও আমেরিকান দূতাবাস। অনুষ্ঠানে অ্যামচেম সভাপতি আফতাব উল ইসলাম, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ এবং অ্যামচেমের নির্বাহী পরিচালক আবদুল গফুরসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের উদ্যোক্তারা অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) কাজ শুরু করার পর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য উন্নত দেশের বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ধারাবাহিকতায় অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ এ সুবিধা পেয়ে আসছে। কিন্তু আমেরিকা এখন পর্যন্ত দেয়নি। উপরন্তু আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের পণ্যে উচ্চ শুল্ক রয়েছে। আমরা আমেরিকার সঙ্গে টিকফা চুক্তিও করলাম। এর উদ্দেশ্যই ছিল দুই দেশের ব্যবসায়িক সহযোগিতা বৃদ্ধি। এরপরও যদি জিএসপি সুবিধা না দেয় তবে টিকফা অকার্যকর হয়ে পড়বে। তাই দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি পণ্য প্রবেশে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমেরিকা আমাদের প্রধান রফতানি বাজার। বিশেষ করে পোশাক খাতের জন্য এ বাজার খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে অতি সম্প্রতি আমেরিকার বাজারে আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা না থাকাকেই দায়ী করেন। এছাড়া কমপ্লায়েন্স ইস্যুর কারণেও কিছু প্রতিষ্ঠান চাহিদা অনুযায়ী রফতানি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, অন্য দেশগুলো আমেরিকার বাজারে যে কম শুল্কের সুবিধা পায় তাও নেই। ফলে বাংলাদেশকে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে। এত কিছুর পরও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশের রফতানি আয় ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে। আর স্বাধীনতার গোল্ডেন জুবিলীতে বাংলাদেশের রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
বিদেশী বিনিয়োগ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হবে বিদেশী বিনিয়োগের কাক্সিক্ষত স্থান। বর্তমানে বাংলাদেশে আমেরিকাসহ অনেক দেশের বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে। সামনে আরও আসবে। এই দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের মাল্টিপল ভিসা ৫ বছরের পরিবর্তে ১০ বছর করারও অনুরোধ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে ড্যান মজিনা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা প্রসঙ্গে দৃঢ় আশাবাদের কথা শোনান। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, উদ্যোক্তা-শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রম, প্রগতিশীল নেতৃত্ব, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ অচিরেই একটি শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে পারবে। এসব কর্মকৌশল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের আগ্রাসন তৈরি হবে। যা বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে বিশাল বাংলাদেশ আগ্রাসন শিরোনামে খবর পরিবেশিত হবে। তিনি মনে করেন, এ খবরের শিরোনাম হতে বাংলাদেশের জন্য হয়তো আগামী ১০-১৫ বছরের প্রয়োজন হবে। কারণ বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ওই সময়ের মধ্যে আমেরিকায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, ওষুধ, প্রযুক্তি, চামড়াজাত পণ্য, বাগদা চিংড়িসহ বিভিন্ন পণ্য ব্যাপক সাড়া জাগাবে। যেখানে মেড ইন বাংলাদেশ নামক পণ্যে ছেয়ে যাবে।
অনুষ্ঠান শেষে ফিতা কেটে ইউএস ট্রেড শো-১৪ এর উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি আফতাব উল ইসলাম এ প্রসঙ্গে জানান, এতে বিভিন্ন খাতের ৪৩টি প্রতিষ্ঠানের ৭৮টি স্টল স্থান পেয়েছে। প্রদর্শনী চলাকালে যে কেউ বিশ টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে এ মেলায় প্রবেশ করতে পারবেন। তবে স্কুলের নির্ধারিত পোশাক অথবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র দেখিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বিনামূল্যে প্রদর্শনীতে প্রবেশ করতে পারবে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে এ মেলা। আগামী বুধবার এ প্রদর্শনী শেষ হবে।
মেলার স্টল ঘুরে দেখা গেছে, আগ্রহী ক্রেতাদের প্রসাধনীর স্টলেই সবচেয়ে বেশি ভিড় পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রদর্শনীতে বিশ্বের সেরা প্রসাধনী ব্র্যান্ড পারসনি, জর্ডানা, লাসপ্লাস, জেকলিনসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ড স্থান পেয়েছে। তবে প্রদর্শনী আমেরিকার পণ্যের হলেও এতে ইন্ডিয়ান প্রসাধনীরও উপস্থিতি দেখা গেছে। স্টল ভেদে এসব পণ্যের দাম নিয়ে হেরফের রয়েছে। বিক্রয়কর্মীরা প্রসাধনী পণ্যের জন্য ১০ শতাংশ ছাড়ের কথা জানিয়েছেন।
অন্যদিকে ভোগ্যপণ্যের মধ্যে প্রায় সবই কোকাকোলা, পেপসি, মেরিন্ডাসহ কোমল পানীয় দেখা গেছে। মেলায় আমেরিকান ইএ ব্র্যান্ডের মোটরবাইক, ফোর্ড ব্যান্ডের গাড়ি, সালফা ইন্টারন্যাশনালের আমেরিকান এয়ারকন্ডিশনার, বয়লারে ব্যবহৃত ম্যাগনেটিভ ডিভাইস, জুতা, ফ্লোরাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কম্পিউটারসামগ্রী, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সেবার মধ্যে ডাচ্-বাংলা, প্রিমিয়ার, মার্কেন্টাইল, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লি. ও আলিকো সেবাপণ্য, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিখ্যাত লুব্রিকেন্ট কনোকা ফিলিপস, সেভরন, বাংলাক্যাট, বোয়িং এয়ারওয়েজ সার্ভিস, পোশাকের স্যাম্পলের মধ্যে ফ্রিডেনবার্গ ও ভিলেনি, ফরচুন প্রভৃতি প্রদর্শিত হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.