বিএনপির টার্গেট জানুয়ারি

আগামী জানুয়ারিকে টার্গেট করে আন্দোলনের চূড়ান্ত রোডম্যাপ তৈরি করার চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপে গণসংযোগ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে দলটি। ডিসেম্বরের শেষের দিকে ঢাকায় মহাসমাবেশ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে তাদের। ওই মহাসমাবেশ থেকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে আলটিমেটাম দেয়া হতে পারে। বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যে দাবি মেনে নেয়া না হলে মধ্য জানুয়ারি থেকে টানা আন্দোলনে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে তারা। আন্দোলনের অংশ হিসেবে টানা হরতাল-রাজপথ-রেলপথ অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিও থাকবে। নেতাকর্মীদের উদ্দীপ্ত করতে চূড়ান্ত আন্দোলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজেই রাজপথে নামতে পারেন। নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে টানা অবস্থান করার চিন্তাভাবনা রয়েছে তার।
এদিকে চূড়ান্ত আন্দোলনের কৌশল নিয়ে কোনো প্রস্তাব থাকলে তা লিখিত আকারে জানাতে সিনিয়র নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন খালেদা জিয়া। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির। আন্দোলনের পাশাপাশি দলের পুনর্গঠনও চলবে সমানতালে। ইতিমধ্যে ছাত্রদলের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। শিগগিরই যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন কমিটি দেয়ার কাজ চলছে। সরকারকে সংলাপে বসাতে চাপ অব্যাহত রাখতে চলবে কূটনৈতিক তৎপরতা। সংলাপে বসাতে ব্যর্থ হলে আন্দোলনে যাতে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন থাকে সে ব্যাপারেও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে চেষ্টা করা হচ্ছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে তাদের আন্দোলন চলমান রয়েছে। সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা ও নির্দলীয় সরকারের দাবির প্রতি জনসমর্থন আদায়ে সারা দেশে তারা গণসংযোগ করছেন। তিনি বলেন, তারা চান আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান। জনগণের ভোগান্তি হয় এমন কোনো কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে নন তারা। কিন্তু সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা সংলাপ নয়, সংঘাতই চাচ্ছে। সরকার যদি তাদের সংলাপের আহ্বানে সাড়া না দেয়, তবে কঠোর আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। সময়মতো আন্দোলন যেভাবে আসা দরকার সেভাবেই আসবে। সেই আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণে কাজ করা হচ্ছে।
আরও জানা গেছে, চূড়ান্ত আন্দোলনের রোডম্যাপ তৈরি করতে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। ওইসব বৈঠকে নেতাদের আরও স্বক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি আন্দোলনের ব্যাপারে যেকোনো সুচিন্তিত মতামত দিতে তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আন্দোলন স্থগিত করা ঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ওই সময় কেউ তার সঙ্গে আলাপ করেনি। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশের মানুষ আন্দোলন চায়। সরকারের বিদায় চায়। ঢাকার বাইরের জনসভাগুলো শেষ হলে আমাদেরকে নতুন করে আন্দোলনের রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। বিদেশীরা তাকে বারবার বলছেন, আপনারা তো রাজপথে কোনো আন্দোলন করতে পারছেন না। সরকারকে তারা কীভাবে নতুন নির্বাচনের জন্য চাপ দেবেন।
সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন খালেদা জিয়া। বলেন, আপনারা নিজেরা তো কোনো কাজ করবেন না, নেতাকর্মীদের দিয়েও কাজ করাতে পারছেন না। এভাবে চলতে পারে না। খালেদা জিয়ার মতে, সিনিয়র নেতারা রাজপথে নামেন না বলেই নেতাকর্মীরা নামেন না। তাই এবার সিনিয়র নেতাদের রাজপথে নামানোর ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। আগামী আন্দোলনে সিনিয়র নেতারা রাজপথে নামবেন কিনা এমন প্রতিশ্র“তিও আদায় করা হয়। সিনিয়র নেতারা রাজপথে না নামলেও তিনি নিজেই নামবেন বলে ঘোষণা দেন।
সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার এমন কঠোর মনোভাবের পর খোলস খুলতে শুরু করেছেন নেতারা। বিশেষ করে আন্দোলনে খালেদা জিয়া নিজে রাজপথে নামার ঘোষণা দেয়ায় সব স্তরের নেতাকর্মীদের মাঝে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। সিনিয়র নেতারা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। শুক্র ও শনিবার স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য এবং সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ভবিষ্যৎ আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে তারা খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করছেন। তারা জানান, বিগত সময়ে আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনেক হটকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ কারণে আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা সম্ভব হয়নি। তাই এবার আন্দোলনের কৌশল চূড়ান্ত ও তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।
সূত্র জানায়, গত আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা না আসার পেছনে ঢাকার ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন নেতাকর্মীরা। তাই এবারের আন্দোলনে ঢাকাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন খালেদা জিয়া। সাদেক হোসেন খোকাকে সরিয়ে মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক করা হয়। কিন্তু আব্বাসের কার্যক্রমে এখনও হতাশ তিনি। দ্রুত ঢাকা মহানগর বিএনপি পুনর্গঠনের নির্দেশ দেন তিনি। সেক্ষেত্রেও তেমন অগ্রগতি নেই। যদিও আগামী মাসের শুরুতেই পুনর্গঠনের কাজ শেষ করতে চান মহানগর নেতারা। ঢাকা মহানগরীর কমিটির পুনর্গঠন শেষ হলেই ডিসেম্বরের শেষে মহাসমাবেশের চিন্তাভাবনা রয়েছে। ওই সমাবেশ থেকেই দাবি আদায়ে সরকারকে আলটিমেটাম দেয়া হতে পারে। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে সরকার দাবি মেনে না নিলে মধ্য জানুয়ারি থেকে শুরু হবে কঠোর আন্দোলন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারা দেশে গণসংযোগের অংশ হিসেবে ঈদুল আজহার পর থেকে আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ শুরু করেছে বিএনপি। গণসংযোগের মধ্য দিয়ে নির্দলীয় সরকারের দাবির প্রতি সমর্থন আদায়ে ইতিমধ্যে আটটি জেলায় সমাবেশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২৯ নভেম্বর কুমিল্লায় হবে তার নবম জনসভা। এরপর আরও দু-একটি জেলায় সমাবেশ করার চিন্তাভাবনা করছেন তিনি। সূত্র জানায়, জেলা সফর শেষে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে আবারও মতবিনিময় করবেন খালেদা জিয়া। আন্দোলনের কৌশল সম্পর্কে তাদের পরামর্শ নেয়া হবে। এরপর সিনিয়র নেতা ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে চূড়ান্ত করা হবে কর্মসূচি। এছাড়া উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক কর্মসূচি ও তা জোরালোভাবে পালনের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেসব পেশাজীবী সংগঠন রাজপথে থাকবে তাদের আন্দোলনের প্রতিও নৈতিক সমর্থন থাকবে বিএনপির।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে না সরকার সহজেই তাদের দাবি মেনে নেবে। আশা করি তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। যদি তা না হয় তবে অধিকার আদায়ে লড়াই ছাড়া বিকল্প নেই। তিনি বলেন, দাবি আদায় করতে যা যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে। সে লক্ষ্যেই তারা কর্মকৌশল চূড়ান্ত করছেন।

No comments

Powered by Blogger.