সময়ের কথা-অনেক টানা ছুটি, আয়োজন কী আছে! by অজয় দাশগুপ্ত

'প্রায় সব মাসেই এমন টানা ছুটি, তা কই যাবেন ঠিক করলেন?' এমন একটি বার্তা এলো ফেসবুকে। কে প্রথম পোস্ট দিয়েছে, জানা নেই। তবে এতে অনুরোধ রয়েছে_ আগেভাগেই যেহেতু জেনে গেলেন বছরে কয়েকবার একটানা ছুটি পাচ্ছেন তিনদিন করে।
এখন থেকেই প্ল্যান করে ফেলুন, পরিবারের সদস্য কিংবা বন্ধুদের নিয়ে কোথায় যাবেন বেড়াতে। ফেসবুক বার্তার বিষয়বস্তু একদম স্পষ্ট_ দিনক্ষণ উল্লেখ করা। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে ও আগস্ট মাসে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে পড়েছে একটি করে সরকারি ছুটির দিন_ একুশে ফেব্রুয়ারি_ বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ_ রোববার (বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন), ১৪ এপ্রিল_ রোববার (বাংলা নববর্ষ, ১৩২০), ২৩ মে_ বৃহস্পতিবার (বৌদ্ধ পূর্ণিমা), ৮ আগস্ট_বৃহস্পতিবার (জন্মাষ্টমী)। এই আগস্টের ১৫ তারিখ_ জাতীয় শোক দিবস, বৃহস্পতিবার। বার্তায় আরও বলা হয়, অক্টোবর মাসের ১১ থেকে ১৯ পর্যন্ত ঈদুল ফিতর ও শারদীয় দুর্গোৎসব পড়বে। সেখানে একটি ব্রিজ হলিডে ম্যানেজ হলে টানা ছুটি মিলতে পারে ৭-৮ দিন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পড়েছে সোমবার এবং ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন পড়েছে বুধবার। অফিসে বলে-কয়ে যদি ১৫ ডিসেম্বর রোববার কিংবা ২৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ছুটি ম্যানেজ করা যায়, তাহলে একটানা ৪ দিন ছুটি মিলবে। সরকারি ও বেসরকারি অফিসগুলো এখনই ভাবতে পারে যে, দুই ছুটির মাঝখানে পড়া একটি দিন কোনো কোনো স্টাফকে ছুটি দিয়ে ছুটিটাকে আরেকটু বড় করে দেওয়া।
ফেসবুকে দেখেছি_ অনেকেই ছুটির বার্তা পছন্দ করেছে লাইক দিয়ে। ছুটির সুখবরের প্রিন্ট নিয়ে কয়েকজনকে দেখিয়েছি। কেউ বললেন_ চমৎকার আইডিয়া। কেউবা বললেন, বাঙালির কাছে ছুটির চেয়ে প্রিয় কিছু নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, তেমন সাংগঠনিক শক্তি নেই এমন কোনো ছাত্র সংগঠন ধর্মঘট ডাকলেও ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে গরহাজির থাকে। ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী যেসব রাজনৈতিক দলকে সাধারণ নির্বাচনে জনগণ বারবার প্রত্যাখ্যান করে, তারা হরতাল ডাকলেও যানবাহন ও দোকানপাট আংশিক বন্ধ থাকে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাই আগাম ছুটি দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বলে দেন, ঝুঁকি নিয়ে আসার দরকার নেই। এমন পক্ষ-বিপক্ষ মন্তব্য নিয়ে নতুন করে বিতর্কের দরকার নেই। বছরের কয়েকটি মাসে ঈদের সময়ের মতো তিন দিন করে ছুটি মিলছে, এটাই বাস্তব সত্য এবং সেটা যেহেতু কেউ কেউ আগাম স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাই ভালো। একটু খোঁজ নিলেই আমরা বুঝতে পারব যে, পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এ ছুটির দিনগুলোর জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। বাড়তি পর্যটকের চাপ কীভাবে সামলাবেন সেটা যেমন ভাবনায়, তেমনি লাভের দিকটাও নিশ্চয়ই বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।
এখন একটি শঙ্কা ও উদ্বেগের কথা বলি। একাত্তরে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর এমন একজন অফিসারের কন্যা তার মা ও মেয়েকে নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাবা যে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন সে দেশ দেখার পাশাপাশি আরও একটি বড় আকর্ষণ ছিল_ এ ভূখণ্ডেই যে জন্মেছিলেন বাবা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওই অফিসারের জন্মস্থান সিলেটের ঢাকা দক্ষিণ এলাকা। ওই মহিলা প্রথমে যেতে চেয়েছেন কক্সবাজার, যেখানে একাত্তরে তার বাবা দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তারপর যাবেন সিলেটে। আমি তাদের জন্য অগ্রিম টিকিট করে রাখলাম সুপরিচিত ও বড় পরিবহন কোম্পানি গ্রিনলাইনের রাজারবাগ অফিস থেকে। ২০ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় বাস। এর কয়েক মিনিট আগে গ্রিনলাইন অফিস থেকে আমাকে ফোন_ 'আমাদের আজকের ঢাকা-কক্সবাজার বাসটি ক্যানসেল করা হয়েছে। আজ দিনে আমাদের কোনো বাস নেই। আপনারা রাত ১০টার দিকে যে বাস রয়েছে সেটাতে যান।' ফোন পেয়ে আমি তো বিস্ময়ে হতবাক। বাসের যাত্রীরা বাসা থেকে রাজারবাগ গ্রিনলাইন বাস টার্মিনালের পথে যাত্রা করে দিয়েছেন। তাদের কর্মসূচি পরপর সাজানো_ কক্সবাজারে হোটেল বুকিং করা আছে। সেখানে কয়েক ঘণ্টা ঘুরে দেখে বাসে চট্টগ্রাম এসে রাতের ট্রেনে যাবেন সিলেট। ট্রেনে টিকিট করা আছে। সিলেটে হোটেল বুকিং দেওয়া আছে। তারপর সিলেট থেকে বাসে ঢাকা ফিরবেন এবং তারও টিকিট করা। এখন গ্রিনলাইন বাসের কর্মকর্তার পরামর্শ মেনে যদি সকালের পরিবর্তে মধ্যরাতের বাসে কক্সবাজার যেতে হয়, তাহলে সব প্রোগ্রাম ওলটপালট হয়ে যাবে। গ্রিনলাইন কর্তৃপক্ষের কাছে যাত্রীদের এ সমস্যা বলার পরও তাদের কোনো উদ্বেগ নেই_ একেবারে হেলেদুলে চলার মতো আচরণ। তাদের সঙ্গে অনেক আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত তাদেরই আরেকটি বাসে ওই তিন যাত্রীকে তারা চট্টগ্রাম পেঁৗছে দেয় এবং সেখান থেকে কানেকটিং বাসে (চট্টগ্রামে তাদের অফিসে ওই তিন মহিলা যাত্রীকে ঘণ্টা দুয়েক বসিয়ে রেখে) মধ্যরাতে কক্সবাজার পেঁৗছানো হয়। এমন কষ্টকর জার্নির পর সমুদ্রসৈকত দেখার আগ্রহ ক'জনের থাকে! বাংলাদেশে ভ্রমণে আসার জন্যও কি তারা উৎসাহ দেবেন?
একটি বড় বাস কোম্পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পটের (কক্সবাজার) লাক্সারি বাসযাত্রীদের সঙ্গে এমন আচরণ করলে সেটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? ফেসবুকের বন্ধুরা ছুটি কাটানোর আগাম পরিকল্পনা করার জন্য বলেছেন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার লোক হয়তো সেটা করবে। কিন্তু তারা যে বাসে বা লঞ্চে যাবে বলে আগাম টিকিট করে রেখেছে, সেখান থেকে যদি গ্রিনলাইনের মতো আচরণ মেলে?
যন্ত্রণা বাড়ানোর মতো আরও অনেক কিছুই হতে পারে। যেমন, টানা তিন দিন ছুটির কারণে যেহেতু যাত্রীর ভিড় বেশি হবে, তাই লঞ্চ ও বাসে ভাড়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে। ঈদের সময় এমনটি হয়। টানা ছুটি যেহেতু কয়েকবার মিলছে, তখনও যাত্রীদের গলাকাটায় দোষ কী! কক্সবাজার, কুয়াকাটা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা, সিলেট, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি প্রভৃতি এলাকার হোটেলগুলো রেট বাড়িয়ে দিলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
পর্যটন মৌসুমে কিংবা লম্বা ছুটির দিনগুলোতে বাস-লঞ্চ-হোটেল-মোটেল মালিকরা কিছু বাড়তি মুনাফা করতেই পারে। কিন্তু তার মাত্রা থাকা চাই। অন্যথায় ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা হতাশ হবেন এবং আখেরে এ শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হবে।
এ তো গেল যাতায়াত ও থাকার সমস্যা। ভ্রমণ-পর্যটনের জন্য মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য মূল বিষয় হচ্ছে পর্যটন স্পট। যেসব স্পট রয়েছে সেগুলো আরও কীভাবে আকর্ষণী করা যায়, সেটা ভাবতে হবে। একই সঙ্গে চাই নতুন নতুন স্পট। আগামী বছরে যে ধরনের 'ছুটির ফাঁদ' রয়েছে তেমনটি পরবর্তী সময়েও আসবে। বিদেশি যারা বাংলাদেশ দেখতে ও জানতে আসবে, তাদের রয়েছে নিজস্ব ছুটির মৌসুম। তাদের ছুটির সময় সম্পর্কেও আমাদের পর্যটন-সংশ্লিষ্টদের ধারণা থাকা চাই। কারও কারও মতে, সবুজ-শ্যামলের বাংলাদেশ যথেষ্ট সুন্দর ও আকর্ষণীয়। আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের অজস্র স্মৃতি ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। অনেক বধ্যভূমি যেমন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের অপরাধের সাক্ষ্য বহন করছে, তেমনি রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও বীরত্বগাথা। এসব জানায় আগ্রহ-উৎসাহ থাকবে অনেকের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অমর একুশের শহীদদের স্মরণে রয়েছে শহীদ বরকত জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। কিন্তু যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দেশ-বিদেশের অনেককে আকর্ষণ করে সে এলাকায় কিছুই যে লেখা নেই! ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় যে গণহত্যা শুরু করে তার প্রধান টার্গেটের মধ্যে ছিল জগন্নাথ হল ও সার্জেন্ট জহিরুল হক হল। ঘুমন্ত শিক্ষক ও ছাত্রদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনও ছিল প্রথম আক্রমণের লক্ষ্য। সেখানে স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠেছে। কিন্তু যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা স্বাধীনতার জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত করে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং এ কারণে ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর জামায়াতে ইসলামীর প্রধান টার্গেট, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা তুলে ধরার জন্য আরও বড় আয়োজন হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যেমন দেশের নানা প্রান্ত থেকে তরুণ প্রজন্ম আসে, পাশাপাশি আসেন বয়স্করা_ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তেমন আয়োজন করাই যায়।
ছুটির কথায় ফিরে যাই। ছুটিতে কেবল পর্যটন কেন্দ্রে যেতে হবে, এমন কথা নেই। কেউ যাবে আত্মীয়-স্বজনের কাছে। কেউবা গ্রামে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিঘেরা এলাকায়। বিয়ে বা অন্য ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্যও বেছে নেওয়া হয় এসব টানা ছুটির দিন। এ জন্য মানুষকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে হবে এবং প্রয়োজনে থাকতে হবে। এর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সমাজের অনেকের ভূমিকা থাকে_ পরিবহন ও হোটেল ব্যবসায়ী, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মী। যদি সুশাসন থাকে তাহলে পর্যটন বাড়ে, এটাই বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা। সমাজে যদি সুখ-শান্তি বিরাজ করে তাহলে ছুটির দিনে দলে দলে নারী-পুরুষ-শিশুরা বের হয়ে পড়ে আনন্দ-বিনোদন-মজার জন্য। বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার যারা দায়িত্বে রয়েছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের যারা কর্ণধার, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-গৌরবের কথা তুলে ধরায় যাদের অদম্য আগ্রহ-উৎসাহ তারা সবাই নিশ্চয়ই এসব নিয়ে ভাববেন।
ফেসবুকে ছুটির দিনের নির্ঘণ্ট যারা ছড়িয়ে দিয়েছেন তাদের অভিনন্দন। তথ্যপ্রযুক্তির এমন ব্যবহারেই সবার কল্যাণ।

অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.