পবিত্র আশুরা-প্রতিষ্ঠিত হোক সত্য ও ন্যায়

মহররম_ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মাস। হিজরি বছরের প্রথম মাসই শুধু নয়, ইসলামের ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এ মাসে। মহররম মাসের দশ তারিখটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। আশুরা শব্দের অর্থ দশম দিন। মহররম মাসের দশম দিনটিকে আশুরা বলা হয়।
হজরত মুসা (আ.) এই দিনে আল্লাহর শোকরিয়া আদায়ের জন্য রোজা রেখেছিলেন। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এই দিনে রোজা রেখেছেন এবং অন্যদের রোজা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। ঐতিহাসিক নানা গুরুত্ব সত্ত্বেও আশুরার যে ঘটনাটি মুসলিম সমাজকে আলোড়িত করে তা হলো, কারবালার শোকাবহ ঘটনা। মহানবীর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন এই দিনে কারবালা প্রান্তরে ৭২ জন সঙ্গীসহ ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেছিলেন। ইসলামের পঞ্চম খলিফা মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের সঙ্গে ইমাম হোসাইনের বিরোধ ছিল আদর্শিক। তিনি ন্যায়নিষ্ঠ শাসক ছিলেন না। মহানবীর যোগ্য অনুসারী কিংবা মুসলিম সমাজের যোগ্য নেতাও ছিলেন না। তিনি ছিলেন ক্ষমতালোভী এবং শাসক হিসেবে ছিলেন স্বৈরতন্ত্রী। উপরন্তু মুসলিম সমাজের যোগ্য প্রতিনিধিরা খলিফা বা আমিরুল মোমেনিন পদে তাকে মনোনয়ন দেননি, বরং ইয়াজিদ জবরদস্তিমূলকভাবে খলিফার পদ দখল করেছিলেন। এ অবস্থায় ইমাম হোসাইন ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এরই পরিণতিতে এক পর্যায়ে মদিনা থেকে কুফা যাওয়ার পথে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক স্থানে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে স্ত্রী, শিশুসন্তানসহ শাহাদাতবরণ করেন। এ ঘটনা মানবজাতির ইতিহাসে এক মর্মন্তুদ শোকাবহ ঘটনা হিসেবে স্থান পেয়েছে। এখন পর্যন্ত সারা দুনিয়ার মুসলিম সমাজ এবং ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে নিপীড়িত মানুষ এই শোকাবহ ঘটনা স্মরণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা লাভ করে। কারবালার ঘটনা শুধু একটি পরিবারের আত্মত্যাগের বা ইমাম হোসাইন ও তার ৭২ জন সঙ্গীর আত্মদানের কাহিনীমাত্র নয়। এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক অনন্যসাধারণ বীরত্বগাথা। অপরপক্ষে মানুষের চরম অধঃপতন, ক্ষমতালিপ্সা ও অর্থলিপ্সার হীন চরিত্রও ফুটে উঠেছে এ ঘটনার ভেতর দিয়ে। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) তার উম্মতের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'তোমাদের কাছে আমার দুটি প্রত্যাশা। এক. আমার আদর্শের অনুসরণ করো; দুই. আমার বংশধরদের প্রতি সদয় হও।' মুসলমানরা প্রতিদিন দরুদের মাধ্যমে অসংখ্যবার মহানবীর বংশধরদের কল্যাণ কামনা করেন। অথচ কারবালার ঘটনায় তার বংশধরদের প্রতি অত্যন্ত নির্মম আচরণ করা হয়েছে। সারা দুনিয়ায় মুসলমানরা চিরকাল এ ঘটনাকে লজ্জা ও গ্গ্নানির বিষয় হিসেবে স্মরণ করেন। আশুরা তাই শোকের দিন। আশুরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্মারক। পৃথিবীর অপরাপর মুসলিমপ্রধান অঞ্চলের মতো আমাদের দেশেও যথাযথ তাৎপর্য ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে আশুরা পালিত হয়। এটি সরকারি ছুটি দিন এবং রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর বাণী প্রকাশ করা হয়। মহররমের দিন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে লোকে মাতম, মর্সিয়া, মিছিলের মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেন। রোজা ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানান। কখনও কখনও শোকের মাতম রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। আমরা আশা করব, এবার তেমনটি ঘটবে না। মানুষ শান্তিপূর্ণ ইবাদতের মাধ্যমে কারবালার ঘটনাবলিকে স্মরণ করবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোথাও মহররম পালনে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটবে না_ এই আমাদের আশা। আজ বিশ্বের নানা দেশে শিয়া-সুনি্ন বিভেদের কারণে মুসলিমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে। এটি কখনোই কাম্য নয়। সংকীর্ণ স্বার্থের বদলে মানবকল্যাণ ও মানবমুক্তির জন্য মহানবীর আদর্শ অনুসরণ করলে মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হবে। এবারের আশুরা মুসলমানদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন প্রতিষ্ঠা করুক, বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আশুরা সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখাক, এই আমাদের প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.