রঙ্গব্যঙ্গ-সব আবুল 'আবুল' না! by মোস্তফা কামাল

আমাদের দেশে আবুল নাম নিয়ে রঙ্গরসের অভাব নেই। নানাজনে নানাভাবে আবুল নামটি ব্যবহার করে থাকেন। কেউ কেউ হাবাগোবা টাইপের লোকদের বলেন 'আবুল'। কেউ আবার কাউকে তিরস্কার করেন আবুল বলে। আবুল যেন এক ধরনের গালি।
বোকার মতো কাজ করলেই বলা হয়, 'লোকটা আবুল নাকি!' ইদানীং আবার বাসার কাজের লোকদেরও নাম যা-ই থাকুক 'আবুল' বলে ডাকা হয়। বাড়ির সবাই যেমন নারী গৃহকর্মীদের 'বুয়া' ডাকে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা ছেলেমেয়ের কোনো বাছবিচার নেই। আবুল সে রকমই একটি কমন নামে পরিণত হয়েছে। আসলে আবুল নামের লোকদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। আবুলরা যে অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে তা কারো চিন্তার মধ্যেই নেই। থাকবেই বা কিভাবে! আবুলরা তো আবুলই! তাদের দিয়ে অলৌকিক কিছু করা কি আদৌ সম্ভব?
আমাদের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে সবাই 'আবুল মন্ত্রী' বলতেন। তাঁকে নিয়ে সরকারও বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিল। তাঁর মূল সমস্যা ছিল কথাবার্তা। কী বলতে কী বলে ফেলেন এর কোনো রেশন কার্ড নেই। একজন মন্ত্রীর বক্তব্যে যে ধরনের আর্ট থাকা উচিত, তা তাঁর ছিল না। তিনি মাদারীপুরের আঞ্চলিকতার টোনে কথা বলতেই বুঝি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এ কারণে তাঁকে নিয়ে হাস্যরসের কোনো কমতি ছিল না। এখনো তাঁকে নিয়ে হাসি-তামাশা হয়। ইদানীং তিনি দুদক নিয়ে মহাঝামেলায় আছেন। দুদক একবার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আবার তাঁকে ডাকা হয়েছে। দুদক নাকি পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির গন্ধ পেয়েছে।
সেসব কথা থাক। আমরা এবার ক্রিকেটার আবুলের প্রসঙ্গে আসি। আমাদের নতুন ক্রিকেটার মৌলভীবাজারের আবুল হাসান অভিষেকেই ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। তাই তাঁকে নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক মাতামাতি হয়েছে। এ রকম ইতিহাস আরেকবার ১১০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার এক ক্রিকেটার সৃষ্টি করেছিলেন। আমাদের এক সহকর্মী হাসি হাসি মুখ করে বললেন, 'সব আবুল আসলে আবুল না!'
আমরা সবাই জানতে চাইলাম, এ কথার মানে কী?
'যারা কোনো কাজের না, তাদের আমরা আবুল বলি। কিন্তু 'খুলনার ক্রিকেট মাঠে ১০ নম্বর ক্রিকেটার আবুল শতরান করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। কি, অবাক করা বিষয় না!'
বিস্ময়ে আমাদের চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা হলো। আমরা একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার মতো অনেকে খেলাটা দেখেননি। সম্ভবত শুরুর খেলা দেখে হতাশ হয়ে অনেকেই টিভি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর আমাদের ওই সহকর্মী হয়তো খেলাটা দেখেছেন। এর পরও আমাদের মনের সন্দেহটা দূর হলো না। তিনি মানুষ হাসাতে ওস্তাদ। হাসানোর জন্য কথাটা তিনি বলেছেন কি না কে জানে।
আবারও আমরা সবাই তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, আসলেই কি এটা সম্ভব? জবাবে তিনি বললেন, আমি হাসাই বলে সিরিয়াস কথাও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। এ তো দেখছি মহাবিপদ! ভাই, বিশ্বাস করেন, আমি সত্যি বলছি। এক দুই তিন। তিন সত্যি। এই আমার মাথায় হাত দিয়ে বললাম। এবার বিশ্বাস হয়েছে?
আমরা ইতিবাচক মাথা নাড়লাম। মনে মনে ভাবলাম, সত্যিই বিস্ময়কর খবর বটে!
এবার আমরা সেই বিস্ময়কর ক্রিকেটারের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই। তবে কথোপকথন অবশ্যই কাল্পনিক।
প্রশ্ন : সবাই বলে, আপনি নাকি ক্রিকেটের বিস্ময়। আপনার মন্তব্য কী?
আবুল : কী যে বলেন! আমি ক্রিকেটের বিস্ময় হব কোন দুঃখে? আমি ভাই সাদামাটা অতি নবীন একজন ক্রিকেটার। ক্রিকেটকে ভালোবাসি। ক্রিকেট আমার ধ্যানজ্ঞান সব কিছু।
প্রশ্ন : খুলনার মাঠে আপনার অভিষেক হলো। তা-ও আবার ১০ নম্বর! অথচ আপনি ক্রিকেট বিশ্বকে যা দেখালেন-
আবুল : হা হা হা! সবে তো শুরু। আরো চমক দেখতে পাবেন। দেখার জন্য অপেক্ষা করুন।
প্রশ্ন : আর কি কি চমক আছে বলবেন?
আবুল : হা হা হা! আমার নামের মধ্যেই তো চমক লুকিয়ে আছে।
প্রশ্ন : মানে!
আবুল : আমাকে সবাই বলে, আমি নাকি আবুল! সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেছিল, আবুল নামছে? ও আর কী করবে? উইন্ডিজের প্রথম বলের ধাক্কা সামলাতে পারে কি না দেখ! বলেন তো! এর চেয়ে অপমানের আর কী হতে পারে! অথচ শুরুতেই কী চমক দেখালাম! হা হা হা। এর পরও কি আবুল আছি? এখন আমার নাম হওয়া উচিত কাবিল! কাবিল ছেলেদের পক্ষেই এ ধরনের চমক দেখানো সম্ভব।
প্রশ্ন : তার মানে আবুল নামটা আপনার পছন্দ নয়?
আবুল : না না। এখন তো আবুল একটা ব্র্যান্ড।
প্রশ্ন : তা ঠিক। আচ্ছা এবার বলেন তো, আর কী কী চমক দেখাবেন?
আবুল : শুরুতেই যেহেতু রেকর্ড গড়েছি। সামনে একটার পর একটা বিশ্ব রেকর্ড ভাঙব। সেটাই আমার শপথ।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকে প্রশংসা করার পরই একেবারে চুপসে যায়; এর কারণ কী?
আবুল : প্রশংসায় ফুলে-ফেঁপে বিশাল আকারের বেলুন হয়। এরপর ফুট্টুস!
প্রশ্ন : বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
আবুল : আমরা করব জয়, আমরা করব জয় একদিন... বাংলাদেশ একদিন আমার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয় করবে। তবে একটা কথা, আমাকে বেশি প্রশংসা করবেন না। প্রশংসা করলেই ক্যারিয়ার শেষ। যত পারেন সমালোচনা করবেন। তাতে আমি বেশি খুশি হব।
প্রশ্ন : আপনার প্রিয় উক্তি কী?
আবুল : শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।
প্রশ্ন : এ মুহূর্তে আপনার চাওয়া কী?
আবুল : কেউ যেন আমাকে আবুল বলে তিরস্কার না করেন।
প্রশ্ন : এ কথা কেন বললেন?
আবুল : খেলা শেষ করে মাঠ থেকে বের হচ্ছিলাম- তখন শুনি, দর্শকরা স্লোগান দিচ্ছে, 'বিস্ময়কর আবুল ভাই, আমাদের কোনো চিন্তা নাই। আবুল নামের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো!' বলেন তো, এটা কোনো কথা হলো? এ ধরনের স্লোগানের কোনো মানে আছে? আর কোনো স্লোগান ছিল না?
প্রশ্ন : আপনিই তো বললেন, আবুল এখন ব্র্যান্ড। কাজেই...
আবুল : ও, তাই তো! কিন্তু আবুল নাম শুনলেই...। যাকগ্যা, এখন তো আমি একটা ব্র্যান্ড; 'আবুল ব্র্যান্ড'। চিন্তা নাই। আমার জন্য দোয়া করবেন। আমার শেষটাও যেন ভালো হয়। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমিন, আমিন।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.