মিয়ানমার- বর্মিরাজ মিনডন থেকে বারাক ওবামা by মিজানুর রহমান খান

বারাক ওবামা, অং সান সু চি ও থেইন সেইন—তিনজনই সংলাপ করলেন। ইয়াঙ্গুন-ওয়াশিংটন সম্পর্কের মাইলফলক সফরটি হলো। ওবামাই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি মিয়ানমার সফর করলেন।
কিন্তু বিস্মৃতির আড়ালেই থাকলেন এক রাজা। তিনি প্রজাবৎসল, মানবতাবাদী ও আর পরমতসহিষ্ণু।
রাজপ্রাসাদের কক্ষ। হঠাৎ তিনি এক আততায়ীর মুখোমুখি। উন্মুক্ত কৃপাণ হাতে আততায়ী লজ্জিত। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে রাজার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলেন। রাজা শুধু ক্ষমা করেই ক্ষান্ত হননি। মুহূর্ত কালবিলম্ব না করে আততায়ীর নিরাপদ পলায়ন নিশ্চিত করলেন।
পরধর্ম-সহিষ্ণুতারও অনুপম দৃষ্টান্ত তিনি। নিজে বৌদ্ধধর্মের দিকপাল হয়েও মুসলিমদের জন্য মসজিদ আর খ্রিষ্টানদের জন্য গির্জা তৈরি করে দিয়েছেন। মুসলিমদের জন্য যাতে শরিয়া আইনের খেলাপ না ঘটে, সে জন্য তিনি ইসলামি বিচারকও নিয়োগ দিয়েছিলেন।
কিছুটা নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়ে যে রাজার কথা বলছি, তাঁর নাম মিনডন মিন। ১৮৫৩ থেকে ১৮৭৮ পর্যন্ত তিনি রাজা ছিলেন। ব্রিটিশ চক্রান্ত সত্ত্বেও মিয়ানমারের শেষ স্বাধীন সম্রাট হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়। বাংলার শেষ নবাব হিসেবে সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্যবিপর্যয়ের ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের স্বাধীনতার সলতে জ্বলছিল। ৭০ বছর বয়সে আমাশয়ে ভুগে রাজা মিনডনের মৃত্যুর মাত্র আট বছর পরে ১৮৮৬ সালে তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মিয়ানমার স্বাধীনতা হারায়। তখন রাজা ছিলেন তাঁরই ছেলে থিব।
এমন এক দয়ালু, পরোপকারী আর মহৎ হূদয় রাজা এই লেখকের কাছে অচেনাই থাকতেন যদি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তৈরি করা প্রাচীন নথিপত্রের মাইক্রোফিল্ম দেখতে দেখতে চোখ আটকে না যেত।
বারাক ওবামার সফরসঙ্গীর দলে ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর দুঁদে সাংবাদিক পিটার বেকার। তিনি ওবামার পিতামহকে নিয়ে ইতিহাসনির্ভর দীর্ঘ এক অনবদ্য প্রতিবেদন লিখেছেন। এর শিরোনাম ছিল ওবামা এমন একটি জাতিকে দেখবেন, যে জাতি তাঁর পিতামহের জীবন গড়েছিল। ওবামা তাঁর একান্ত নাড়ির টানে ঠিকই তাঁর পিতামহের স্মৃতিবিজড়িত এলাকায় যান।
পিটারের বর্ণিত গল্পের সারকথা হলো, ওবামার কেনীয় পিতামহ হোসেন অনিয়াঙ্গো ওবামা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে এক ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনের বাবুর্চি ছিলেন। এমনকি ওবামার বিয়েপাগল পিতামহ সেখানেও এক বর্মি দুহিতাকে মন-প্রাণ সঁপেছিলেন। সে কারণে বিশেষজ্ঞ ও মার্কিন মিডিয়া ‘প্রথম ওবামা নয়, দ্বিতীয় ওবামার’ মিয়ানমার সফরকে কৌতূহলের সঙ্গে দেখেছেন। অনিয়াঙ্গো ওবামার জন্ম ১৮৯৫ সালে।
তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নথি সাক্ষ্য দিচ্ছে, বারাকা ওবামার পিতামহের জন্মের প্রায় চার দশক আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি মৈত্রী চুক্তি করার স্বপ্ন দেখেছিলেন বর্মিরাজ মিনডন মিন।
গণতন্ত্রপন্থী যুবক কো কো গি ১৮ বছর জেল খেটে ওবামার সৌজন্যে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি আবেগভরে বলেছেন, ‘ওবামা বাকস্বাধীনতার কথা বলেছেন। ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলেছেন। সব মানুষের জন্য মানবাধিকারের কথা বলেছেন। আমরা দেখতে চাই এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন কতটা স্থায়ী।’ কেউ কেউ হয়তো জানেন বা জানেন না, তাঁদেরই রাজা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সামরিক শাসকেরা তাঁদের দেশ ছারখার করেছেন।
২৪ আগস্ট। রেঙ্গুনের মার্কিন কনস্যুলেট থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় মিনডনের মৈত্রী চুক্তির আকাঙ্ক্ষা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। সেটি বর্মি ভাষায় লেখা হলেও তাতে পালির প্রাধান্য ছিল। এ নিয়ে বহুকাল মার্কিন প্রশাসন ধাঁধায় ছিল। কারণ, তারা নিশ্চিত ছিল না, এটা ঠিক কী। অনেকে ভাবতেন, এটা একটা চুক্তি। এরপর তা প্রথম তরজমা করেন রেঙ্গুনের আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট মিশন পরিচালিত কুশান হাইস্কুলের শিক্ষক উ পি মেয়া। এরপর মার্কিনিরা প্রথম জানতে পারে, এটা চুক্তি নয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাংকলিন পিয়ার্সের কাছে রাজা মিনডনের লেখা চিঠি। ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৭ তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ১৪তম প্রেসিডেন্ট। তবে প্রেরক ও প্রাপকের নাম না লেখা এই চিঠি প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছায়নি। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাঁর মাধ্যমে এই চিঠি ওয়াশিংটনে পৌঁছায়, তিনি হলেন মিয়ানমারের বরেণ্য মার্কিন মিশনারি ড. কিনকার্ড। রাজা মিনডনের সেই রাজকীয় চিঠি ছিল রাজকীয় কারুকার্যখচিত। এটি রাখা ছিল গজদন্ত দিয়ে তৈরি বাক্সে এবং সেটিতে টকটকে লাল মখমলের ঝালর ছিল।
বর্মিরাজের সেই চিঠিতে তাঁর দেশের পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা দেওয়া ছিল। তাঁর ভাষায়, ‘মহান নৃপতিগণ যে ন্যায়দণ্ড হাতে নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করে এসেছেন, সেটা তাঁর শাসনব্যবস্থারও মূলমন্ত্র। সব জাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং সেটা যাতে অনন্তকাল ধরে অক্ষয় থাকে, সে জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা। তাই দুই মহান দেশের জনগোষ্ঠী যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মৈত্রীর সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে, সে জন্য বর্মিরাজের পক্ষ থেকে একটি বন্ধুত্ব ও বাণিজ্যবিষয়ক চুক্তি সম্পাদনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে। এবং আশা করছে যে এর ফলে দুই দেশের ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ এবং সব শ্রেণী ও গোত্রের মানুষ বিরাট সুবিধা ও সহায়তা ভোগ করতে পারে।’
মিনডন ধর্মভীরু ছিলেন। ১৮৭১ সালে বার্মায় পঞ্চম ভিক্ষু মহাসম্মিলন ডেকেছিলেন। এতে দুই হাজার ভিক্ষু অংশ নেন। এর পূর্ববর্তী দুই হাজার বছরে এমন ভিক্ষু সম্মিলন ডাকা হয়নি। মহামতি বুদ্ধের নির্বাণ লাভের ৪৫৫ বছর পরে সর্বশেষ এমন সভা বসেছিল। আর সেটা ছিল যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৯০ বছর আগে। তিনি তাঁর রাজধানী মান্ডালের একটি প্যাগোডায় ৭৩৯টি মার্বেল পাথরে বৌদ্ধ আইন খোদাই করে রেখেছেন।
ওবামা ইয়াঙ্গুনে ৩২৫ ফুট দীর্ঘ বিশ্বের প্রাচীনতম শেডাগন বৌদ্ধমন্দিরে গিয়েছিলেন। এই মন্দিরে মিনডনের দান করা সোনায় মোড়া ছাতা আছে। স্যামুয়েল উইলিয়াম ককস লিখেছেন, ‘মিনডন মানবতাবাদী। সত্যনিষ্ঠ। তাঁর আগে রাজা ছিলেন পাগান মিন। কিন্তু রাজকুমার হিসেবে মিনডন ও তাঁর ভাই দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে তিনি তাঁদের হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। এটা টের পেয়ে ১৮৫২ সালের ১৭ ডিসেম্বর মিনডন তাঁর ভাইকে নিয়ে শেবোতে পালিয়ে যান।’
কোনবং ডাইন্যাস্টি রয়্যাল হিস্ট্রির মতে, ওই সময় দুই যুবরাজের দেহরক্ষী ছিলেন দুই মুসলিম। মুসলিম পদাতিক সেনাদের একটি দলও সপক্ষ ত্যাগ করে এবং শিগগিরই পাগানকে পরাস্ত করে দুই ভাই সিংহাসনে আরোহণ করেন। ব্রিটিশরা তত দিনে পেগু দখল করে নিয়েছে। মিনডন যুদ্ধবিরোধী। রক্তপাত এড়িয়েছেন সব সময়। আইনের শাসন ও অহিংসায় তাঁর বিশ্বাস ছিল। তাই ব্রিটিশদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে পেগু ফেরত পেতে তিনি কলকাতায় দূত পাঠিয়েছিলেন। যদিও তাঁর মিশন ব্যর্থ হয়েছিল।
মিয়ানমার যখন দুয়ার খুলছে তখন তারা তাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের দিকে তাকাতে পারে। বৌদ্ধধর্মের প্রতি মিনডনের গভীর অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও তিনি অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রতি সাম্য নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। খ্রিষ্টধর্মের প্রসারে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দেন। আবার নিজের প্রাসাদের কাছে স্বর্ণ দিয়ে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এমনকি বর্মি মুসলমানেরা যাতে সৌদি আরবে গিয়ে সুষ্ঠুভাবে হজব্রত পালন করতে পারেন, সে জন্য মক্কায় একটি অতিথিশালা নির্মাণ করেন।
তিনিই প্রথম গেরস্থপ্রতি গড়ে ১০ রুপি করে কর বসান এবং সেই করের টাকায় কর আদায়কারীদের বেতন ও জনহিতকর কাজে তা ব্যয় হয়। এই পদক্ষেপটি তাঁকে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। এর আগ পর্যন্ত করের টাকা মন্ত্রী ও রাজপরিবারের সদস্যদের ভোগে ব্যয় হতো।
এটা ঠিক যে মিয়ানমারের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ইতিহাসে রক্তপাত ও হানাহানি কম নেই। কিন্তু মিনডনের মতো অসাম্প্রদায়িক শাসনকীর্তিও রয়েছে। তা ছাড়া জাতিগত সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও রাজনৈতিক অস্থিরতামুক্ত শান্ত পরিবেশও তার ইতিহাসের অংশ।
বারাক ওবামা রোহিঙ্গাদের অধিকার ও তাদের নিজেদের করে নিতে প্রথমবারের মতো অকপটে যা বললেন, সেটা আমরা শুনতে অপেক্ষায় ছিলাম। তিনি বলেছেন, ‘আজ আমি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এটা স্বীকার করতে হবে গায়ের রঙের কারণে একদা সেই দেশটিতে আমার ভোটাধিকার ছিল না।’ ওবামা কিন্তু বিরল ক্ষেত্রেই গায়ের রং নিয়ে কথা বলেন। তাঁকে অভিবাদন। রোহিঙ্গাদের জীবনে ওবামা যেন মার্টিন লুথার কিং হয়ে এসেছেন। তবে এখন দেখার বিষয় হবে মিয়ানমার সরকারপ্রধান ও অং সান সু চির আগের অবস্থানে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসে কি না। আশা করব, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওবামার কণ্ঠস্বরকে দ্রুত আমলে নিতে কার্পণ্য করবে না। বাংলাদেশকে দোষারোপ না করে কিংবা তাকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমার-ওয়াশিংটন সম্পর্কের ক্রমবিকাশের জন্য এটা একটা পরীক্ষা।
সব মিলিয়ে আমরা দেখব, মিয়ানমারের সেই মহৎপ্রাণ রাজার অভিপ্রায় সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় কি না।
১৫৬ বছর আগের মিয়ানমার যে মৈত্রী চুক্তি চেয়েছিল, সেটি এবার সই হয়নি। কিন্তু সে ধরনের পথে নিশ্চয়ই যাত্রা ঘটেছে। আমরা অবশ্য তাদের মধ্যকার সেই মৈত্রী চাইব। কিন্তু তার মূলমন্ত্র হতে হবে রাজা মিনডন যা বলেছেন, ‘সকল জাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব।’ তাঁর ব্যবহূত মিয়ানমারের ‘সকল শ্রেণীর’ মঙ্গল কথাটি রোহিঙ্গাদের জীবনে ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবেই প্রতিভাত হতে পারে।
ওয়াশিংটন থেকে
 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.