পরাগের বাবার দাবি-মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি

শিশু পরাগকে উদ্ধার করতে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিতে হয়েছে বলে আলোচনা রয়েছে। পরাগ উদ্ধারের দিন র‌্যাব জোরালোভাবেই দাবি করে, মুক্তিপণের ৫০ লাখ টাকা হস্তান্তরের পরই অপরাধীরা পরাগকে মুক্ত করে দেয়। কিন্তু গতকাল শনিবার পরাগের বাবা মুক্তিপণের বিষয়টি পুরোপুরি নাকচ করে দেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেছেন, অপহরণকারীদের কোনো মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি।
অপহরণের মূল হোতা আমিরকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিপণ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, গত ১১ নভেম্বর কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে শিশু পরাগকে অপহরণের পর ঘটনায় অভিযুক্তরা মুক্তিপণ নিয়েছিল- এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণের লোভেই পরাগকে অপহরণ করা হয় বলে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার আগেই গত ১৩ নভেম্বর পরাগকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনারের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম ছাড়াও ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান ও পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ডিসি মনিরুল ইসলাম জানান, জীবিত পরাগকে উদ্ধার করাই তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল। এ কারণে ঘটনার পরপরই মামলার আসামিদের স্বজনদের পুলিশ হেফাজতে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে চাপ সৃষ্টি করা হয়। টাকা নেওয়ার আগেই বিভিন্ন শর্ত দিয়ে 'হোস্টেজ নেগোসিয়েশন'-এর মাধ্যমে পরাগকে উদ্ধার করা হয়।
৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে পরাগকে উদ্ধার করা হয়- র‌্যাবের এমন দাবির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি মনিরুল বলেন, 'এটা র‌্যাবের ব্যাপার। র‌্যাব যে দাবি করেছে আমরা তার কোনো ভিত্তি পাইনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও বিষয়টি জানেন না। ৫০ লাখ টাকার বিষয়টি র‌্যাব কোন মাধ্যম থেকে পেয়েছে তা জানতে প্রয়োজনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের সঙ্গেও কথা বলবেন।'
পরাগের বাবা তাঁতীবাজারের জেকো ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিমল মণ্ডল গতকাল দুপুরে পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'আমি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নাই। আমার কাছে মুক্তিপণের টাকা চাওয়া হয়নি।'
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিমল আরো বলেন, 'আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি না। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আমার কোনো শঙ্কাও নেই। আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি, আর কোনো ভাবনা নেই। তবে আর কোনো বাবা যেন ছেলে-মেয়েকে হারিয়ে কষ্ট না পায়।'
পুলিশ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গতকাল উপস্থিত করা হয়েছিল আমিরের সহযোগী আল আমিন ও শ্যালক মামুনকে। পরাগ অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আল আমিন সাংবাদিকদের জানায়, ঘটনার আগে সে আমিরের বাসায় কাজের জন্য এসেছিল, 'ওই দিন সকালে আমির ভাই আমাকে একটি কাজের কথা জানিয়ে সঙ্গে যেতে বলে। এরপর আমিরের বাসা থেকে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে ওই শিশুকে কিডন্যাপ করা হয়। আমি মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলাম। এ সময় আমার পেছনে বসে থাকা আমির ভাই গুলি করে শিশুকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে জোরে টান দিতে বলে।'
পরাগকে অপহরণের পর বিষয়টি পুলিশকে জানাননি কেন- প্রশ্নের জবাবে আল আমিন বলে, 'বইলা দিলে যদি আমারে মাইরা ফ্যালে'- এ ভয়ে কিছু বলা হয়নি। পরাগকে আপহরণের আগে সে কিছুই জানত না বলে দাবি করে।
আল আমিন সাংবাদিকদের জানায়, অপহরণের পর আলীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে পরাগের স্বজনদের কাছে টাকা চাইতে বলে আমির। এদিকে সংবাদ সম্মেলনে থাকা আমিরের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বড় ভাই মামুন দাবি করে, সে অপহরণের সঙ্গে জড়িত নয়। পরাগ অপহরণের পর ডিবি পুলিশ তাকে ডেকে নিয়ে গ্রেপ্তার করেছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মামুন বলে, 'আমির আমার ভগ্নিপতি ছিল। '৯৮ সালে আমিরের সঙ্গে আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়।' এরপর ২০০৯ সালে তার বোনের সঙ্গে আমিরের ছাড়াছাড়ি হলেও ব্যবসায়িক কারণে দুজনের যোগাযোগ ছিল বলে স্বীকার করে মামুন।
ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পরাগ অপহরণে জড়িত অভিযোগে আমিরসহ এ পর্যন্ত মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যরা হলো- শুভাঢ্যা ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি আমিনুল হক ওরফে মোল্লা জুয়েল, আমিরের মোটরসাইকেল চালক আল আমিন, আমিরের ভগ্নিপতি আবুল কাশেম, আমিরের আত্মীয় মামুন, অটোরিকশাচালক কালাচান, স্থানীয় তরুণ জাহিদুল হাসান, আলী ওরফে রিফাত, আলফাজ ও রিজভী আহমেদ অনিক। তাদের কারো কাছ থেকেই মুক্তিপণ আদায়সংক্রান্ত তথ্য মেলেনি।
গত ১৫ নভেম্বর র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক জিয়াউল আহসান সাংবাদিকদের বলেন, অপহরণকারীরা দুই কোটি টাকা মুক্তিপণ চেয়ে পরাগের বাবার কাছে ফোন করেছিল। এরপর তা এক কোটি টাকায় নামে, শেষে ৫০ লাখ টাকায় রফা হয়। টাকা লেনদেনের বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। আমিরকে গ্রেপ্তার করা হলেই টাকা লেনদেনের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। একই কথা সেদিন জানিয়েছিলেন র‌্যাব মুখপাত্র এম সোহায়েল।
১৪ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরও সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, 'শিশু পরাগ উদ্ধারে কোনো লেনদেন হয়েছে- এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই।'

No comments

Powered by Blogger.