কারখানাটিই ছিল মৃত্যুকূপ by মনজুর আহমেদ

তাজরীন ফ্যাশনস কারখানার ভবন তৈরিতে নির্মাণবিধি একেবারেই মানা হয়নি। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই এটা হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ। আর সিঁড়ি তিনটি হয়ে পড়ে ইটভাটার চিমনি। ফলে এ পথে শ্রমিকের নেমে আসা বা ছাদে উঠে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বলছে, তাজরীন ফ্যাশনস একটি ‘কমপ্লায়েন্ট ফ্যাক্টরি’ (শ্রমিকের কর্মপরিবেশ উপযোগী)। কিন্তু ভবনটি পরিদর্শন করার পর এই দাবি সঠিক নয় বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ফলে অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন শ্রমিকের মৃত্যুর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না মালিকপক্ষ, বিজিএমইএ ও সরকার।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, কারখানার তিনটি সিঁড়িই ছাদে গিয়ে মিলিত হলেও নিচের দিকটা এসে মিশেছে নিচতলায়। আর এই নিচতলার পুরোটাই ছিল গুদাম বা ওয়্যার হাউস। এখানেই লাগে আগুন। পেট্রোলিয়াম বায়ো প্রোডাক্ট বা সিনথেটিক-জাতীয় সুতা ও কাপড়ে পরিপূর্ণ ছিল সেখানে। অতি দাহ্য এই মালামালে আগুন লাগার পর দ্রুত প্রচণ্ড কালো ধোঁয়া তৈরি হয়।
আগুনের তাপ, শিখা ও কালো ধোঁয়া একত্রে ইটভাটার চিমনির মতো খোলা পথ তিনটি সিঁড়ি বেয়ে আকাশমুখী হয়। যে পথে শ্রমিকের নেমে আসা বা ছাদে উঠে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। এই সিঁড়িগুলো কোনোভাবেই বিকল্প সিঁড়ি যেমন নয়, তেমনি একে দ্রুত অগ্নিনির্গমনের পথ হিসেবে তৈরিও করা হয়নি। কারখানার নিচতলা থেকে ভেতর দিয়ে তৈরি সিঁড়িকে দেয়াল দিয়ে পৃথকও করা হয়নি। নিয়ম হলো, সিঁড়িকে কেন্দ্র করে প্রতিটি তলায় ছাদ পর্যন্ত নিরাপত্তার দেয়াল থাকবে। কিন্তু তাজরীনে নিচতলায় এসে সিঁড়িগুলো মিলেছে ওয়্যার হাউসে।
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস একাধিকবার ঘুরে ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এমন সব তথ্য ও অভিমত মিলেছে।
স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেনও একাধিকবার গিয়েছেন তাজরীন ফ্যাশনসে। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নির্মাণবিধি এখানে একেবারেই মানা হয়নি। আর আগুন লাগার পর সিঁড়ি হয়েছে ইটভাটার চিমনি।’
তাজরীন ফ্যাশনসের মূল প্রতিষ্ঠান তুবা গ্রুপ। তুবা গ্রুপের ওয়েবসাইটের (গত সোমবার দুপুরে যেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়) তথ্য অনুসারে পোশাক ও পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট ১৩টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই গ্রুপের। সরেজমিনে জানা যায়, বিশেষত বস্ত্র তৈরি হয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুতা ও কাপড়ের গুদাম বা ওয়্যার হাউস হিসেবে তাজরীন ফ্যাশনসের নিচতলা ব্যবহার করা হতো। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেলোয়ার হোসেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে ইতিমধ্যেই বলেছেন, তিনি তাজরীনের নিচতলাকে অন্য কারখানার সুতা ও কাপড় বিতরণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতেন।
তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের সময় চতুর্থ তলায় কাজ করছিলেন অপারেটর রাজীব। চতুর্থ তলা থেকে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তিনি গ্রিল ও কাচ ভেঙে লাফিয়ে নামেন পাশের টিনের ছাদে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা সৌভাগ্যবান এই আহত শ্রমিক রাজীব গতকাল বলেন, এক দিন আগেই গুদামে নতুন করে বেশ কিছু সুতা ও কাপড় আনা হয়।
বিজিএমইএ স্বীকার করেছে, পেট্রোলিয়াম বাই প্রোডাক্ট ছিল গুদামে। আর প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, এগুলোর মধ্যে ছিল অ্যাক্রিলিক ইয়ার্ন ও ফ্লিজ ফেব্রিক, যা অতি দাহ্য পদার্থ। ফলে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে এটা হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ। ওপর থেকে নেমে এসে শ্রমিকদের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা জেনেছি, তিনটি সিঁড়ি আছে। আরও অনেকগুলো শর্ত পূরণ করা হয়েছে। ফলে আমরা বলেছি, এটা কমপ্লায়েন্ট ফ্যাক্টরি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন যদি এই সিঁড়িগুলো আপনার কথা অনুসারে নিচতলায় ওয়্যার হাউসের সঙ্গে গিয়ে মেশে, আর সেটা অনুসন্ধানে বের হলে তবে ভিন্ন কথা।’ উল্লেখ্য, সফিউল ইসলাম গতকাল দুপুরে দেশে এসেছেন। তিনি এখনো কারখানা দেখতে যেতে পারেননি।
কারখানার নিচতলায় ওয়্যার হাউস করতে হবে এমন কোনো শর্ত ক্রেতা বা সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের আছে কি না, প্রশ্নে সফিউল ইসলাম বলেন, নেই। তবে রাজস্ব বিভাগের বন্ডের ওয়্যার হাউসের শর্তে কত দূরত্বের মধ্যে তা হবে, সেটি উল্লেখ আছে। আর বিজিএমইএ সূত্র বলছে, কারখানার নিচতলায় ওয়্যার হাউস নয়, থাকতে হয় গাড়ির গ্যারেজ। দ্বিতীয় তলা থেকে আসলে কারখানার শুরু।
পোশাক কারখানায় ফায়ার সার্ভিস ম্যানুয়ালের শর্ত হচ্ছে, ওয়্যার হাউসের মধ্য দিয়ে কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ লাইন যেতে পারবে না। ওয়ালমার্টসহ বেশ কিছু বড় ব্র্যান্ডের শর্তও এটি। বিজিএমইএর সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এই শর্ত আমাদের ম্যানুয়ালেও আছে বা আমরা মেনে চলি।’
ওয়্যার হাউসে যদি বৈদ্যুতিক সংযোগ লাইন না থাকে, তাহলে রাতে কীভাবে কাজ করা যেতে পারে—এ প্রশ্নে বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘সে ক্ষেত্রে আমাদের বাইরে থেকে সার্চলাইট দিয়ে কাজ সারতে হবে অথবা ভেতরে চার্জার নিয়ে কাজ করা যাবে।’ অগ্নিদুর্ঘটনায় আক্রান্ত তাজরীনে এসব শর্তের কোনো কিছুই মানা হয়নি।
তাজরীন ফ্যাশনস একেবারে পল্লির মধ্যে স্থাপিত। সেখানে এ ধরনের কারখানা আদৌ হতে পারে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আবার কারখানা যে হলো, কোনো অগ্নিদুর্ঘটনা হলে ফায়ার সার্ভিস কীভাবে সেখানে পৌঁছাবে, তার পরিবহন, পানি কীভাবে আসবে, সে ব্যবস্থাও নেই। ফায়ার সার্ভিসের শর্ত হচ্ছে, কারখানার চারদিক খোলা থাকতে হবে। যাতে চারদিক থেকে আগুন নেভাতে দমকলকর্মীরা আগুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন। কিন্তু তাজরীন ফ্যাশনসের সামনের দিকে ৮ থেকে ১০ ফুট পিচের রাস্তা ছাড়া বাকি তিন দিকেই লাগোয়া বাড়িঘর রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস এখানে কীভাবে কারখানা নির্মাণের প্রত্যয়নপত্র দিল, জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, কারখানার অনেক কিছুই তাঁদের শর্তের সঙ্গে মেলে না। আর এ ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে তা হলো, হয়তো যখন ফায়ার সার্ভিসের প্রত্যয়নপত্র নিয়েছে, তখন বাকি তিন দিক খোলা ছিল। পরে তিন দিকেই দালানকোঠা নির্মাণ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.