জ্বালানি- ফুলবাড়ীর সাহস ও নিশানা by আনু মুহাম্মদ

২৩ নভেম্বর সকালেই আমরা ফুলবাড়ী রওনা হয়েছিলাম। বেলা তিনটায় সেখানে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রতিবাদ সমাবেশ। এই প্রতিবাদ সমাবেশের কারণগুলোর মধ্যে আছে প্রথমত, বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রচার।
দ্বিতীয়ত, ফুলবাড়ীসহ ছয় থানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেরিত সার্কুলার। এবং তৃতীয়ত, দিনাজপুর এলাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সফর।
সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টের বক্তব্য নিয়ে সব জাতীয় পত্রিকায় প্রায় অভিন্ন শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বিশেষজ্ঞ কমিটি উন্মুক্ত খননের পক্ষে সুপারিশ করেছে। সেই বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট তখনো এবং এখনো সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়নি, প্রকাশিতও হয়নি। প্রকৃতপক্ষে রিপোর্টের বক্তব্য এত সরল নয়।
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই আমরা জানতে পারি যে দিনাজপুর জেলা, ফুলবাড়ীসহ ছয় উপজেলায় এশিয়া এনার্জি যাতে নির্বিঘ্নে ‘জরিপকাজ’ চালাতে পারে, তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রশাসন ও পুলিশ কেন্দ্রগুলোতে নির্দেশ পাঠিয়েছে। সবাই বিস্মিত, হঠাৎ করে এই সার্কুলার কীভাবে আসে? তাহলে বিশেষজ্ঞ কমিটি কেন? এশিয়া এনার্জি নামের কোম্পানিটিকে বহিষ্কার ও উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধসহ ছয় দফার ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। তার তবে কী হলো? খুনি, দুর্বৃত্ত ধরতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যর্থ, আর বিতাড়িত কোম্পানিকে নিয়ে জনগণের মুখোমুখি সংঘাতে যেতে তার এত সক্রিয়তা কোথা থেকে আসে? ফোনে সার্কুলারের খবর জানাতে গিয়ে ফুলবাড়ীর মানুষই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি এশিয়া এনার্জির লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চায়? তারা কি এখানকার পরিস্থিতি জানে না? এশিয়া এনার্জির কাজ করতে এখানে কারও ঢোকার ক্ষমতা নেই। মাঝখানে শুধু অশান্তি হবে।
ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির উন্মুক্ত খনি প্রকল্প নিয়ে গত কয়েকটি সরকারের তৎপরতাই বরাবর অস্বচ্ছ, নানা রকম বৈপরীত্যে ভরা। বর্তমান সরকার একদিকে বলে যাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের মতামত ও জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করেই কয়লা উত্তোলন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, অথচ সেসব না করেই চলে যাচ্ছে সার্কুলার! প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগেই বললেন, মানুষ, পানি, মাটি ধ্বংস করে উন্মুক্ত খনি করা যাবে না। কয়লা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মজুত থাকুক, প্রযুক্তির বিকাশ হলে করা যাবে। কিন্তু জ্বালানিবিষয়ক সংসদীয় কমিটি জার্মানি ঘুরে এসে উন্মুক্ত খনির পক্ষে প্রচারণা চালিয়েই যাচ্ছে। নানা সময়ে উন্মুক্ত খনির পক্ষে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের নানা সদস্য। এসব গোপন-প্রকাশ্য তৎপরতাই মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও সতর্কতার প্রধান কারণ।
মার্কিন দূতাবাসের ভূমিকা নিয়েও কথা উঠেছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টাকে এশিয়া এনার্জির উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ীর কয়লা উত্তোলনের জন্য যে চাপ দিয়েছেন এবং জ্বালানি উপদেষ্টা যে সে অনুযায়ী কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা উইকিলিকসে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যেভাবে এ প্রকল্পের পক্ষে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে এটা বোঝা যায় যে তিনিও একই পথে অগ্রসর হচ্ছেন। ১০ নভেম্বর থেকে চার দিন ধরে তাঁর দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চল সফর ও কথাবার্তা নিয়েও তাই অনেক প্রশ্ন ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
২.
অনেক রকম ধরাধরি, চাপ, লবিং, মিডিয়াসহ নানা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারসহ বহুবিধ গোপন-প্রকাশ্য তৎপরতা সত্ত্বেও এশিয়া এনার্জি বা জিসিএমের ফুলবাড়ী উন্মুক্ত কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে তথ্যযুক্তি ক্রমে বাড়ছেই। সরকার বহু রকম কমিটি গঠন করেছে: নূরুল ইসলাম কমিটি, পাটোয়ারী কমিটি, তার পর্যালোচনা কমিটি, সর্বশেষ ২০১১ সালে মোশাররফ কমিটি। অনেক রকম অসংগতি ও স্ববিরোধিতা থাকলেও, নানা চাপ সত্ত্বেও, কোনো কমিটিই এই কোম্পানির দেওয়া প্রকল্পের পক্ষে রায় দিতে পারেনি। বরং দেশে-বিদেশে তাদের প্রকল্প নিয়ে অনেক ভয়াবহ দিক উন্মোচিত হওয়ার পর ২০০৮ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এই প্রকল্প থেকে সরে গেছে। কয়েক মাস আগে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল এই প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর না হতে সরকারকে বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছে।
সর্বশেষ রিপোর্টে (জানুয়ারি, ২০১২) বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণে বাংলাদেশে উন্মুক্ত খনির ভয়াবহ ঝুঁকিই বরং বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘উন্মুক্ত খনি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে, কিন্তু পরিবেশের বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও প্রতিবেশগত ক্ষতি বর্ধিত কয়লা উত্তোলনের থেকে প্রাপ্ত সুবিধার তুলনায় অনেক বেশি।’ (পৃ. ১৫)
ফুলবাড়ীর কয়লা প্রকল্পের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেদনে বিস্তৃত বলা হয়েছে। যেমন, ‘প্রতি ১ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলনের জন্য ২৫ মেট্রিক টন ওভারবার্ডেন সরাতে হবে। এই ভূগর্ভস্থ দ্রব্য যেগুলো প্রধানত দূষিত, তা রাখতে হবে পার্শ্ববর্তী কৃষিজমি, জলাশয় ও নদীতীরে। এগুলো যে শুধু আশপাশের জলাশয়কে দূষিত করবে তা-ই নয়, তার নিচের দিকের সব নদী, খাল ও জলাভূমিকে ভয়াবহ মাত্রায় দূষিত করবে।...বৃষ্টির কারণে অনেক বর্জ্য পানিতে ধুয়ে যাবে এবং তা জমি, নদী, জলপ্রবাহ, নদীকে বিষাক্ত করবে।’ (পৃ. ৪৯) রিপোর্টে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া কিংবা জার্মানির সঙ্গে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, ভূতাত্ত্বিক ও জনসংখ্যাগত দিক ইত্যাদির তুলনা খারিজ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতিতে উন্মুক্ত খনির কোনো নজির নেই।
এত সব ভয়াবহ ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করার পরও রিপোর্টের শেষে গিয়ে বড়পুকুরিয়ায় বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে
উন্মুক্ত খনন করার প্রস্তাব করা হয়েছে! কীভাবে এটা হতে পারে?

৩.
পথেই আমরা প্রথমে শুনলাম প্রশাসন থেকে সভার কাজ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এর কয়েক মিনিটের মাথায় শুনলাম ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বন্ধ করতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। আমরা সভার নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগেই গিয়ে পৌঁছলাম। ততক্ষণে পুরো এলাকা পুলিশে ভরা। পুরো শহরের অলিগলিতে মানুষ। মেয়েরাও ছোট ছোট জটলায়। সবার চেহারা ভারী। পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তারা আমাদের সরে যেতে বললেন। আমরা লিখিত চিঠি চাইলাম, কোন এলাকায় ১৪৪ জারি করা হয়েছে, তার বিবরণ ও কেন এটা করা হলো তার ব্যাখ্যা চাইলাম। তাঁরা কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না। ততক্ষণে প্রশাসনের মাইকে বলা হচ্ছে ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার...’, আমরা এই উসকানিমূলক মিথ্যাচার বন্ধ করতে বললাম।
পরিস্থিতি যা তাতে হরতাল ঘোষণা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। বস্তুত, এই সিদ্ধান্ত এলাকার মানুষ আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। এই ঘোষণার আগেই ছোট ছোট মিছিল শুরু হয়েছে। গলিতে সভা-সমাবেশ চলছে। ক্রমে এগুলোর সংখ্যা বাড়ছে। কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে শহীদুল্লাহ ভাইসহ আমরা রাস্তায় হাঁটতে থাকলাম। আমাদের সামনে ততক্ষণে হুইলচেয়ারে বসে চলতে শুরু করেছেন বাবলু রায়, ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর যাঁর দুটো পা চিরতরে অচল হয়েছে। তিনি ভ্যান চালাতেন। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম, সরকার একটি সমাবেশ বন্ধ করেছে, কিন্তু কার্যত ৮-১০টি সমাবেশ হচ্ছে। মিছিলের সংখ্যা আরও বেশি।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সব খণ্ড খণ্ড মিছিল একসঙ্গে হলো। প্রায় ১৫ হাজার মানুষ তখন প্রধান রাস্তায়। হাতে লাঠি ও ঝাঁটা নিয়ে মেয়েদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। পুলিশের দখলমুক্ত হলো সভামঞ্চ ও শহর। নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা পর সমাবেশের কাজ শুরু হলো। পরের দিন হরতালও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার। জীবন, সম্পদ ও দেশকে দেশি-বিদেশি লুটেরা দখলদারদের হাত থেকে রক্ষার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের প্রতিরোধের ভাষা এই হরতাল। রাস্তায় সারাক্ষণই হাজার হাজার মানুষ।
রাষ্ট্র যদি জনগণের জীবন ও সম্পদ কেড়ে নেওয়ার আয়োজন করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাংবিধানিক এখতিয়ার জনগণের আছে। পাহারাদারের দায়িত্ব তাদেরই। মুক্তিযুদ্ধের এই বাংলাদেশে এখন দেখি, মানুষের মতো তুচ্ছ আর কিছু নেই! তার জীবনের দাম সবচেয়ে কম, তার সম্পদের ওপর শকুনের নজর সর্বক্ষণ। এই ‘তুচ্ছ’ মানুষই ইতিহাসে বারবার নিজের অন্তর্গত শক্তি সামনে এনে দেখিয়েছেন যে, এই দেশ তাঁদের, এই দেশের সম্পদের প্রতিটি কণা দেশের মানুষের, দেশি-বিদেশি লুটেরাদের জন্য দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের সর্বনাশ তাঁরা হতে দেবেন না। এটাই মুক্তিযুদ্ধ! লুটেরা দখলদারদের দাপট, নৃশংসতা, অমানবিকতার অসহ্য সমাবেশের মধ্যে জনগণের এই উত্থানই আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের সামনে আশার বাতি। ২৩ নভেম্বর ফুলবাড়ীর মানুষ সভামঞ্চ ও শহর দখলমুক্ত করেছেন, দেখিয়েছেন সজাগ মানুষের ঐক্য ও শক্তি দেশকেও দখলমুক্ত করার ক্ষমতা রাখে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.