এখনই মুখ ফেরাবে না বিদেশি ক্রেতারা by টিটু দত্ত গুপ্ত ও আবুল কাশেম

১৯১১ সালে নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গল শার্টওয়েস্ট কারখানায় আগুনে পুড়ে ১৪৬ জন মারা গিয়েছিল, যাদের বেশির ভাগই ছিল নারী। নিহতদের মধ্যে ১১ বছরের শিশুও ছিল। কারণ ছিল বাংলাদেশের তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের মতোই।
চুরির ভয়ে নিউ ইয়র্কের ওই পোশাক কারখানার সদর দরজা ও সিঁড়ি ছিল তালাবদ্ধ। প্রাণ বাঁচাতে অষ্টম, নবম ও দশম তলা থেকে লাফিয়ে রাস্তায় পড়ে মারা গেছে শ্রমিকরা। আমেরিকার শিল্পকারখানার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের পর তৈরি হয়েছিল আমেরিকার কারখানায় নিরাপত্তা মান এবং গঠিত হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল লেডিস গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। এ ঘটনার কথা উল্লেখ করে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা বলেছেন, এ দুর্ঘটনা আমেরিকার কারখানার পরিবেশ ও নিরাপত্তার ধারণা পাল্টে দিয়েছিল। তাজরীন ফ্যাশনসের দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশের পোশাক খাত। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন বলেই নয়, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কাজটি করতে হবে বলেই সবার মত।
শ্রমিকদের অধিকার অস্বীকার করে, কারখানাকে মৃত্যুকূপ বানিয়ে রেখে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে রপ্তানি বাজার যে ধরে রাখা যাবে না- এ সতর্ক সংকেত দিয়েছেন দেশের বিশেষজ্ঞ ও শ্রম অধিকারকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, ভস্মীভূত কারখানার সঙ্গে সম্পর্ক আছে- কেবল এ কারণে আমেরিকার ক্রেতারা এখনই ওয়ালমার্টে কেনাকাটা বন্ধ করবে, এমন আশঙ্কা নেই। বড় বড় খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশের মতো সস্তা উৎস সহজে হাতছাড়া করতে চাইবে না। তবে আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তিশালী সামাজিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোকে উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে কঠিন। সেসব বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে তাদের স্বার্থেই বাংলাদেশের পোশাক খাতের পরিবেশ ও নিরাপত্তা উন্নয়নে সহায়তা করা।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ও শ্রম সম্পর্কের অধ্যাপক জেমস গ্রস রয়র্টার্সকে বলেছেন, বেশির ভাগ মানুষই দরকষাকষি পছন্দ করে। কোন পণ্য, কারা, কিভাবে তৈরি করেছে, এসব পণ্য কেনা উচিত কি না- এসব ভাবার সময় বা ইচ্ছা তাদের নেই।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিনারজিস ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কর্ণধার মুনির মাশুকুল্লাহ বলেন, এসব বাজারে ক্রেতাদের মানসিকতা হচ্ছে বেশি দাম না দেওয়া। সে কারণে আমদানিকারকরাও খরচ কমানোর রাস্তা খোঁজে। পশ্চিমা খুচরা বিক্রেতা এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের প্রস্তুতকারীদের সঙ্গে ব্যবসা করে মুনিরের প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, যদি ক্রেতারা বেশি দাম না দিতে চায়, কম্পানিগুলোও পণ্য উৎপাদনে বেশি খরচ করবে না।
আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার পরপরই বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট সমালোচনার মুখে পড়েছে। বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানটি ওই কারখানা থেকে পোশাক আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০১০ সালে হা-মীম গ্রুপের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাদের ক্রেতা গ্যাপও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিল। এর পরও 'গ্যাপ' ওই কারখানা থেকেই পোশাক আমদানি করেছে। ওয়ালমার্ট তাজরীন ফ্যাশনস থেকে পোশাক না নেওয়ার কথা বললেও অন্য কারখানা থেকে যে নেবে না, তা বলেনি। এখানেই স্বস্তি মালিকদের। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো মার্টই বাংলাদেশে চ্যারিটি (দান) করতে আসে না। বাংলাদেশ থেকে পোশাক না নিলে তাদের শেলফে মাল যাবে কোথা থেকে? তারা কী বিক্রি করবে?'
তবে তাজরীনের ঘটনায় হতবাক হয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকরাও। শতাধিক লাশ যে পুরো জাতিকে নাড়া দিয়েছে তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন বিজিএমইএর সভাপতি। তবে এ ঘটনার কারণে ক্রেতা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা নেই বলেও মনে করেন তিনি। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে জন্য সব মালিককে ডেকে কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থা আরো জোরদার করাসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বিকাশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির করুণ ইতিহাস। তা সত্ত্বেও বিজিএমইএর নেতারা এমনটি বলতেই পারেন। কারণ, আমেরিকার ক্রেতাদের কাছে এসব খবর নতুন নয়। অ্যাপলের আইফোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান চীনের ফঙ্কন কারখানায় শ্রমিকের আত্মহত্যা, ইন্দোনেশিয়ায় নাইকোর কারখানায় শিশুশ্রম, মেক্সিকোর সীমান্তবর্তী কারখানাগুলোতে ব্যাপক ধর্ষণ- এসব খবরে আমেরিকার খুব কম ক্রেতাকেই বিচলিত হতে দেখা যায়। পণ্যের দাম ও মানটাই তাদের কাছে মুখ্য।
তবে এতে নির্ভার থাকার সুযোগও নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, ক্রেতারা এসব দুর্ঘটনার স্মৃতি ভুলে গেলেও শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো ভোলে না। বাংলাদেশে এ ধরনের সংগঠনের কথা সরকার বা ব্যবসায়ীরা শোনে না। তবে ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের সংগঠনগুলো বেশ সোচ্চার ও প্রভাবশালী। তাদের কথায় প্রভাবিত হয় সরকার; কেবল একটি সংগঠনের আপত্তির কারণে ছয় বছর ধরে ঝুলে আছে আমেরিকায় বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সম্ভাবনা। তাঁরা বলছেন, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর প্রতিবেশী মিয়ানমারও অচিরেই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই ষড়যন্ত্রের দোহাই দিয়ে পোশাক খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও বাজার ধরে রাখা বেশি দিন সম্ভব হবে না। ফ্যাক্টরির পরিবেশ উন্নত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য সরকার ও পোশাক মালিকদের একযোগে কাজ করতে হবে। শ্রমিকদের স্বল্প মজুরি আর নিরাপত্তাহীন কর্মস্থল বিশ্বে কারো আর অজানা নেই। শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং তাদের সঙ্গে নিয়েই কারখানার পরিবেশ উন্নত করতে হবে। তাজরীনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছেন পোশাক শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তারও।
পোশাক শিল্প মালিক ও বায়িং হাউসের প্রতিনিধিরা বলছেন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নসহ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর কাজের পরিবেশ ভালো করার জন্য মালিকদের ওপর বারবার চাপ দিচ্ছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য পয়সাও খরচ করছে তারা। হা-মীম গ্রুপে অগ্নিকাণ্ডের পর গার্মেন্টে অগ্নিনির্বাপণসহ কর্মক্ষেত্র উন্নয়নে 'গ্যাপ' ১০০ কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বখ্যাত ১৯টি ফ্যাশন ব্র্যান্ড সম্মিলিত উদ্যোগে শ্রমিকদের জন্য 'আর নয় আগুন' ব্যবস্থাপকদের জন্য 'এখনই সময়' নামে অগ্নি নিরাপত্তা-বিষয়ক দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দিয়েছে। গ্যাপ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ববি সিলড্রেন গত মাসে বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরের সঙ্গে দেখা করে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ এবং এ জন্য কারিগরি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পোশাক শিল্পে দুর্ঘটনা রোধ এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে বাংলাদেশকে। উদ্যোক্তা, সরকার, শ্রমিক সংগঠন ও বিদেশি ক্রেতাদের একযোগেই কাজটি করতে হবে। তিনি বলেন, কারখানা নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কি না তা দেখার দায়িত্ব সরকারের। একই সঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশি ক্রেতারা লাল, নীল, হলুদ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে বাংলাদেশের কারখানাগুলোকে। অথচ চেষ্টা করে কত কম দামে পোশাক কেনা যায়।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইউরোপ, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বিভিন্ন বড় ব্র্যান্ডের কাপড় রপ্তানিকারক কে আই হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওয়ালমার্ট, গ্যাপের মতো অন্য ক্রেতারাও কারখানায় কাজের পরিবেশ ভালো করার জন্য নানা ধরনের সহায়তা দেয়, শর্তারোপ করে। শর্ত পূরণ না করলে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি কমিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেয় তারা। তবে যেহেতু বাংলাদেশের বিকল্প বাজার দুনিয়ায় আর নেই, তাই বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ থেকেই পোশাক নিতে হচ্ছে তাদের। আর এ সুযোগে মালিকরাও নির্ভার থাকছেন। তবে নিজস্ব ক্রেতাদের অনবরত চাপ, শ্রমিক সংগঠন ও গণমাধ্যমের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের সুনাম রক্ষার খাতিরে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো দেশকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললে তখন আমাদের আর যাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না।'

No comments

Powered by Blogger.