চরাচর-মফস্বলের পত্রিকা হকার by বিশ্বজিৎ পাল বাবু

প্রায় ১০ কিলোমিটার বাইসাইকেল চালিয়ে এসে চেহারায় ক্লান্তির ছাপ কিংবা বিষণ্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সকালবেলা শাহ আলমের মুখে থাকে চিরচেনা হাসি। আবার প্রায় ১৫ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে আসা শাহ আলমের সঙ্গে যখন পড়ন্ত বিকেলে দেখা হয়, তখনো সালাম জানিয়ে হেসেই বলেন, 'ভাই, কোথায় গেছিলেন কিংবা কেমন আছেন।
'আখাউড়ার পত্রিকা বিক্রেতা মো. শাহ আলমের কথা বলছি। সবাই তাঁকে চেনে হকার শাহ আলম হিসেবে। পত্রিকার সঙ্গে তাঁর 'সখ্য' ২০-২২ বছরের। বললেন, 'আমার বয়স যখন ১০-১১ বছর, তখন থেকেই পত্রিকা বেচি। বিজয়নগর উপজেলার মেরাসনীর গ্রামের বাড়ি থেকে রোজ সকাল সাড়ে ৭টা-৮টায় সাইকেল নিয়া বাইর অই। আখাউড়া রেলস্টেশন থেইক্কা পত্রিকা নিয়া খড়মপুর, আজমপুর, সিঙ্গারবিল, বিষ্ণুপুর পর্যন্ত বিলি করতে করতে সন্ধ্যা অইয়া যায়। আগে বিজয়নগর উপজেলার হরষপুর পর্যন্ত যাইতাম। অহন অন্য লোক দিয়া চালাইতাছি।'
মফস্বলের পত্রিকা হকার শাহ আলমদের সত্যিই খুব পরিশ্রম করতে হয়। মাইলের পর মাইল হেঁটে কিংবা সাইকেলে তাঁরা পত্রিকা বিলি করেন। এক দিনও 'ফাঁকি' দেওয়ার সুযোগ নেই তাঁদের। রোদ, বৃষ্টি কিংবা প্রচণ্ড শীত_কোনো কিছুতেই যেন তোয়াক্কা নেই তাঁদের।
প্রায় ৭০ বছর বয়সী হকার আখাউড়ার মনিয়ন্দ গ্রামের মো. মন্তু মিয়া বলেন, '২৫ বছর দইরা এই ব্যবসাত আছি। একদিন বাইর অইবার সুযোগ পাই না। আরেক জনরে দায়িত্ব দিলে হে বালামতে বিলি করতে পারে না। মাসকি (মাসিক) গ্রাহক চিনানডা কষ্ট হইয়া জাগা। বাড়িত থেইক্কা বাইর অইতাম পারি না দেইক্কা বিয়া দিয়া দেওয়া পাঁচ মাইয়া আমারে আইয়া দেইক্কা যায়।'
দিনভর সাংবাদিকদের খবর সংগ্রহ, পাঠানো রিপোর্ট পত্রিকা অফিসে এডিট, অতঃপর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ছাপা হয় পত্রিকা। আর এ পত্রিকা পাঠকের হাতে পাঠানোর মতো গুরুদায়িত্বটাই পালন করে হকাররা। পাঠকদের কাছেও এদের একটা আলাদা কদর রয়েছে। হকাররাও অনেক গুরুত্বের সঙ্গে পাঠকদের হাতে পত্রিকা তুলে দেয়। তবে এ ব্যবসায় খুব একটা লাভবান নন বলেই জানালেন আবুল মিয়া (৬৫)। ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি এ পেশায়। হার্টে সমস্যা থাকায় ওজন বইতে পারেন না বলে বাইসাইকেল কিনেছিলেন পত্রিকা বহনের জন্য। কয়েক দিন আগে এটা চুরি হলে আরেকটা নিতে খুব হিমশিম খেতে হয়েছে। বয়স হয়ে যাওয়ায় অন্য কোনো পেশায় যেতে পারেন না বলেও জানালেন তিনি। এ ছাড়া এ পেশায় তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
আবুল মিয়া বলেন, 'এখন দিন যত বাড়ছে ততই বাড়ছে পত্রিকার গ্রাহকের সংখ্যা। তবে অনেকে বিল দিতে গড়িমসি করেন বলে সমস্যায় পড়তে হয়।'
হকার মোহাম্মদ আলী শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। তিনি জানান, মূত্রনালিতে সমস্যা নিয়েও তিনি পত্রিকা বিলিয়ে যাচ্ছেন। টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। এ পেশায় খুব একটা ভালো নেই তিনি। তিনি বলেন, 'পত্রিকা বিলি করি ঠিকই, কিন্তু পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। তবে এলাকার কোনো খবর এলো কি না তা জেনে নিই। যে পত্রিকায় খবরটা আসে সেই পত্রিকা আরো আগ্রহ নিয়ে বিক্রি করি।'
বিশ্বজিৎ পাল বাবু

No comments

Powered by Blogger.