আরো ৩০ গার্ডার ঝুঁকিতে-চট্টগ্রামে ফ্লাইওভারে ফের দুর্ঘটনার আশঙ্কা by ভূঁইয়া নজরুল

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্মাণাধীন বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের আরো ৩০টি গার্ডার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। গার্ডার তৈরির প্রায় ৯০ দিন পর সেগুলো নিয়ে এসে ফ্লাইওভারে সংযুক্ত করে একধরনের টানা (লোহার রড দিয়ে জোড়া) দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু এই ৩০টির ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
ফলে ভূমিকম্প কিংবা ঝাঁকুনিতে যেকোনো সময় ২৪ নভেম্বরের মতো আবারও দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চৌধুরী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এক দিনের জন্যও কাজ বন্ধ রাখা নিরাপদ নয়। ঠিকাদারের শ্রমিক পাওয়া না গেলে প্রয়োজনে ভাড়ায় শ্রমিক নিয়ে এসে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গার্ডারগুলো টানা (টেনশনিং) দেওয়া উচিত। পাশাপাশি লোহার রড দিয়ে সব গার্ডার পরস্পর যুক্ত করা প্রয়োজন। অন্যথায় গার্ডারগুলো যেকোনো সময় ধসে পড়ে আবারও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।'
নাসির উদ্দিন চৌধুরী আরো বলেন, 'গার্ডারগুলো টেনশনিংয়ের পর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা যাবে। তবে সবার আগে ঝুঁকিতে থাকা এসব গার্ডার ঝুঁকিমুক্ত করা প্রয়োজন।'
গার্ডারগুলো দ্রুত টেনশনিং করা প্রয়োজন জানিয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পুরকৌশল বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'টেনশনিং না করে রেখে দেওয়া গার্ডারগুলো সবার আগে যুক্ত করা প্রয়োজন। উভয় পাশে লোহার রড দিয়ে টেনশনিংয়ের পাশাপাশি গার্ডারের মাঝখানে থাকা লোহার রড দিয়ে গার্ডারগুলো যুক্ত করতে হবে।'
ফ্লাইওভার নির্মাণে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে ড. জাহাঙ্গীর আরো বলেন, 'জুনের ঘটনার পর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। তাই এখন বুয়েট ও চুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে এর নকশা ও সহনক্ষমতা পরীক্ষা করা উচিত। পরে বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে ফ্লাইওভারের বাকি কাজ শেষ করতে হবে।'
সিডিএর প্রকৌশলীরা জানান, ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এক দশমিক চার কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভারে ১৬৬টি গার্ডারের মধ্যে ৩৫টি এখনো তৈরি হয়নি। গার্ডার নির্মাণের প্রায় ৯০ দিন পর তা শিপমেন্ট (স্থানান্তর) করে টেনশনিং (টানা) দিতে হয়। অন্যথায় এসব ফ্রি গার্ডার যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে। গত ২৯ জুন একটি এবং শনিবার রাতে ধসে পড়া তিনটি গার্ডারের কোনোটিই টানা ছিল না। এরই মধ্যে চান্দগাঁও থানার সামনের একটি গার্ডার টানা না থাকায় হেলে পড়েছে। ১১ ও ১২ নম্বর পিলারের মধ্যবর্তী স্থানে একটি গার্ডার হেলে রয়েছে। একেকটি স্প্যানে (দুই পিলারের মধ্যবর্তী জায়গা) সাতটি করে গার্ডার থাকে। কোনো কারণে একটি গার্ডার হেলে পড়লে বাকিগুলোও ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে পারে। গত শনিবার একটি গার্ডার স্থানান্তর করার সময় একদিকের হাইড্রলিক প্রেসার অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় সেটি ভারসাম্য হারিয়ে হেলে পড়ে এবং এর প্রভাবে দুটি গার্ডার নিয়ে নিচে পড়ে যায়। একই কারণে এখনো টানা না থাকায় আরো ৩০ গার্ডার যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে বলে প্রকৌশলীদের আশঙ্কা।
উদ্ধার অভিযান শেষ
গার্ডার ধসে পড়ার ৬০ ঘণ্টা পর উদ্ধার অভিযান শেষ করেছে সেনাবাহিনী। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের সহ-সমন্বয়ক কর্নেল মোহাম্মদ নাইম আশফাক চৌধুরী অভিযান ইতি টানেন। গতকাল আর কোনো লাশ পাওয়া যায়নি। ফলে বহদ্দারহাট ট্র্যাজেডিতে মৃতের সংখ্যা ১৫ তে অপরিবর্তিত থাকল। তবে সরকারি হিসেবে লাশের সংখ্যা ১৩।
উদ্ধার কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে কর্নেল মোহাম্মদ নাইম আশফাক চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, 'শনিবার ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ার পর স্থলভাগে থাকা দুটি গার্ডার ৩৯ টুকরো করার পর নিশ্চিত হয়েছি সেখানে আর কোনো লাশ নেই। তাই টানা ৬০ ঘণ্টার উদ্ধারকাজের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে।'
পুকুরে ডুবে থাকা গার্ডারের নিচে লাশ থাকতে পারে এ প্রশ্নের জবাবে আশফাক চৌধুরী বলেন, 'নৌ-বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি ও আমাদের শক্তিশালী সার্চ ক্যামেরা দিয়ে দেখেছি, পুকুরে কোনো লাশ নেই।'
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে জানান, 'সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে উদ্ধার কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলেও বিকেল চারটায় জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান আনুষ্ঠানিকভাবে এর সমাপ্তি ঘোষণা করেন।'
পুকুরে ডুবে থাকা গার্ডার বিষয়ে জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান বলেন, 'স্বজন নিখোঁজ রয়েছে এমন কোনো দাবি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এখনো কেউ করেনি। সবাই অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলছেন। এখন স্থানীয় মানুষ নিজেদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার আমার কাছে জানালে পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
চট্টগ্রামে বিএনপির মানববন্ধন
বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ধসের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি গতকাল মঙ্গলবার সকালে বহদ্দারহাট মোড়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এ সময় পুলিশ বিএনপি নেতাদের ঘিরে রাখে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ধসের ঘটনা সরকারের দলীয়করণ, দুর্নীতি আর দুঃশাসনের আরেকটি বড় নমুনা। অবিলম্বে বহদ্দারহাট ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের শেষ পর্যায়ে বিএনপি নেতারা বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ধসের প্রতিবাদে আগামী ২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ভবন ঘেরাও করার কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনের পরিচালনায় মানববন্ধনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপি নেতা মোহাম্মদ মিয়া ভোলা, এম এ আজিজ, এস এম সাইফুল আলম, জাহাঙ্গির আলম, পেশাজীবী নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবু সুফিয়ান, জাকারিয়া সেলিম, নাজিমুর রহমান, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন, কাউন্সিলর মাহবুব আলম প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.