সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর by মো. আবু জাফর আজাদ

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের গেটওয়ে ও লাইফলাইন হিসেবে খ্যাত। ১৮৮৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস সুপ্রাচীন হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক বন্দর ব্যবস্থাপনার গোড়াপত্তন ঘটে। দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯২ শতাংশ মালামাল এ বন্দরের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে থাকে।
তাই চট্টগ্রাম বন্দর দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও লাভজনক সংস্থা হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় দেশি-বিদেশি ভেস্টেড গ্রুপ এ বন্দরকে লুটেপুটে ভাগবাটোয়ারা করে গ্রাস করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। ১৯৯৬ সালে আমেরিকার কম্পানি এসএসের মাধ্যমে এদেশীয় কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজশে পতেঙ্গা মোহনার মুখে নেভি গেটের সম্মুখস্থলে একটি প্রাইভেট পোর্ট নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সচেতনগোষ্ঠী ও ২২ সংগঠনের মোর্চার বিরোধিতার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। তার পরও বন্দরকে নিয়ে নানা ধরনের প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে, যা কারো কাম্য হতে পারে না এবং ধারাবাহিকভাবে বন্দর উন্নয়নের ভালো কাজগুলো কোনো পক্ষ থেকে স্বীকার ও জাতির কাছে তুলে ধরা হয় না। তাই দীর্ঘ ট্রেড ইউনিয়ন করার অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান বন্দরের বাস্তবতা তুলে ধরার ব্রতী হচ্ছি।
১৬ কোটি মানুষের ন্যাচারাল পোর্ট, যা গড গিফটেড। সাবেক চেয়ারম্যানের ধারাবাহিকতায় বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ (ট্যাজ), এনডিসি, পিএসসি বিএন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পর থেকে তাঁর প্রজ্ঞা, মেধা ও বিচক্ষণতা দিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলকে নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ফলে বিভিন্ন প্রজেক্টের মধ্যে অতি দ্রুততার সঙ্গে ঢাকার কেরানীগঞ্জে বন্দর ও বিআইডাবি্লউটিএর যৌথ উদ্যোগে প্রায় ১৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পানগাঁও কনটেইনার ইয়ার্ড সম্পন্ন হওয়ার পথে। এটি বাস্তবায়িত হলে বছরে এক লাখ ২৫ হাজার কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁওয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে নদীপথে চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বর্তমানে পানগাঁও আইসিটির নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। ২০০৬ সালে এর কাজ আরম্ভ হলেও ধীরগতিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে আবদ্ধ ছিল। বর্তমান চেয়ারম্যান বন্দরে যোগদানের পর থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব প্রজেক্ট দ্রুততার মধ্যে শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে, এর মধ্যে এটি অন্যতম। তাই তাঁর দিকনির্দেশনায় এটি অতি দ্রুততার মধ্যে চালু হতে যাচ্ছে। আশা করা যায়, আগামী ২০১৩ সালের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ওই কনটেইনার ডিপো উদ্বোধন করা হবে বলে জানা গেছে। এর উদ্বোধন হলে এশিয়ার মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর শ্রেষ্ঠতর বন্দর হিসেবে সুনাম অর্জন করবে, আরো অনেক ধাপ এগিয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম বন্দরে Vessel Traffic Management Information system (VTMIS) চালু এবং সলটগোলা উড়াল সেতু উদ্বোধন করার ফলে বন্দরে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেকাংশে যানজট হ্রাস পেয়েছে। সব মহলে এটি প্রশংসিত হয়েছে। পানগাঁও আইসিটি চালু করা হলে ভিশন ২০২১ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দর একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় উন্নয়নের প্রতীক। তাই অন্যান্য সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বন্দর কর্তৃপক্ষ তার চার্জ বা মাসুল বৃদ্ধি করতে পারে না। সে কারণে কস্ট বেইসড ট্যারিফের ভিত্তিতে ১৯৮৬ সালে বন্দরের যে চার্জ বা মাসুল নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা অদ্যাবধি চালু আছে। এখানে উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কস্ট বেইসড ট্যারিফ নির্ধারণের জন্য ১৯৮৪ সালে মেসার্স প্রাইস ওয়াটার হাউস, ইউকে ও এর কাউন্টার পার্ট হিসেবে মেসার্স রহমান অ্যান্ড কো. নিয়োগ করা হয়। তাদের প্রণীত ও সুপারিশকৃত কস্ট বেইসড ট্যারিফ সরকার কর্তৃক ১৯৮৬ সালে গেজেট বিজ্ঞপ্তির আকারে প্রকাশ করে, তা এখনো বিদ্যমান আছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে ৬০টি মূল ট্যারিফ আইটেম রয়েছে। ১৯৮৬ সালের পর থেকে বিগত প্রায় ২৬ বছর অত্যন্ত জরুরি ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি ট্যারিফ আইটেম ব্যতীত সামগ্রিকভাবে ট্যারিফ রেট পুনর্নির্ধারণ করা হয়নি। যদিও দুই বছর পর পর অন্তত ট্যারিফ আপডেটেড করার ব্যাপারে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সুপারিশও ছিল। যদিও ট্যারিফ আপডেটেড করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। যত দূর জানা যায়, ১৯৯২ সালে সব আইটেমের ওপর ১৫ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রহস্যের বেড়াজালের ফলে তখন ব্যবসায়ী মহলের বিরোধিতার কারণে তা কার্যকর হয়নি, যা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বাস্তবতার নিরিখে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দৈনন্দিন খরচ মেটানো ছাড়াও প্রশাসনিক ব্যয়, ওভারহেড এক্সপেনডিচার, বিদ্যমান সম্পদের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্টসহ বিভিন্ন স্থাপনা আধুনিকীকরণ বা পুনঃ স্থাপন, বন্দরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ব্যয় এবং ৪ শতাংশ রেভিনিউ সারপ্লাস বিবেচনায় এনে কস্ট বেইসড ট্যারিফ নির্ধারিত হয়ে থাকে। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ পার্শ্ববর্তী দেশের ট্যারিফ রেটের তুলনায় অনেকাংশে কম।
চট্টগ্রাম বন্দরের রেভিনিউ সারপ্লাস জাতীয় রাজস্ব আয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। সে পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন করপোরেট আয়কর, ভূমি উন্নয়ন কর, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ট্যাক্স, বন্দর ব্যবহারকারীসহ বিভিন্ন ঠিকাদার বা সাপ্লাইয়ার থেকে ভ্যাট খাতে কোটি কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে Port Facilities বৃদ্ধি করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, বন্দর ব্যবহারকারীরা তা চিন্তায় আনে না। বন্দর কর্তৃক ট্যারিফ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ব্যবসায়ী মহলের তীব্র বিরোধিতার কারণে এ যাবৎ বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হয়নি।
পরিশেষে বলতে চাই, বন্দর সচল রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলকে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সৎ পরামর্শ দিতে হবে। যাতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতের On going project, up coming project, future project-গুলো সুচারুরূপে চালানোর উদ্যোগ নিতে পারে। ইতিমধ্যে চেয়ারম্যান, চবক মহোদয় আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট ত্বরিতগতিতে চালু করার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে অন্যতম Capital dredging and bank protection with jetty facilities in the karnaphully River from Sadarghat Jetty to Karnaphully Bridge, Feasibility study Karnaphully container Terminal (KCT), construction of Laldia Break Bulk Terminal under public private partnership, Construction of CPA Hospital Complex in place of existing Hospital construction of Cardiology Unit beside proposed CPA Hospital Complex, construction of CPA Rest house beside existing Rest house, Rest house, Dhaka Rest house building build up with own resources-�i gva�Gg Kiv Reconstruction of port stadium, construction of Flyover from karnaphully bridge to Chittagong Air port, Deep Sea port etc. উল্লেখযোগ্য।
উপরিউক্ত বর্ণনার আলোকে বলতে চাই, ১৬ কোটি মানুষের অফুরন্ত সম্পদ চট্টগ্রাম বন্দর। উদাহরণ দিয়ে বলি, সিঙ্গাপুর পোর্টের আয় থেকে সে দেশের গধীরসঁস ইঁফমবঃ প্রণীত হয়। বন্দরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতিপরায়ণ নয়। মুষ্টিমেয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির কারণে দেশ ও জাতির কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হোক, তা মেনে নিতে পারি না। বর্তমান চেয়ারম্যানের কাছে অনুরোধ, প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন-২১ বাস্তবায়ন করতে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, যার কারণে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়ন থাকা সত্ত্বেও এত বছর যাদের জন্য ঢাকায় নিজস্ব রেস্ট হাউস গড়ে ওঠেনি, তাদের অপকর্ম, দুর্নীতি ইত্যাদি তদন্ত হওয়া দরকার।

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক
চট্টগ্রাম বন্দর শ্রমিক লীগ (সিবিএ)

No comments

Powered by Blogger.