এখনও গেল না বর্ণবৈষম্য! by মানিক সরেন

আদিবাসীরা এখনও যেসব বৈষম্যের শিকার, তার একটি হলো সমাজের কারও কারও কাছে 'অস্পৃশ্য' বিবেচিত হওয়া। তাদের সঙ্গে এক কাপে বা এক প্লেটে খাবার খেতে চায় না অনেকে।


কিন্তু একটি জেলা শহরের সর্বজনীন প্রতিষ্ঠানেও যে এমন ঘটতে পারে, তা না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবিতে গত ৪ অক্টোবর জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতাকর্মীরা জয়পুরহাট জেলার দুর্গাদহ এলাকা থেকে লংমার্চ করে জয়পুরহাট শহরে আসেন এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। অংশগ্রহণকারীদের জন্য জয়পুরহাট বার সমিতির ক্যান্টিনে দুপুরের খাবারের অর্ডার দেওয়া ছিল। সে অনুযায়ী তারা সেখানে যান। খাওয়ার সময় তারা স্বভাবতই ক্যান্টিনের গ্গ্নাস ব্যবহার করেন। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। জয়পুরহাট বার সমিতির সদস্যদের কেউ কেউ সেখানে এসে এতে আপত্তি জানান এবং ক্যান্টিন ম্যানেজারকে গালাগাল দিতে থাকেন। তারা বলেন, গ্গ্নাসগুলো অস্পৃশ্য হয়ে গেছে। ম্যানেজার চাপে পড়ে জয়পুরহাট আদিবাসী পরিষদের সভাপতি বাবুল রবিদাসকে ২৬টি গ্গ্নাস দিয়ে দাম পরিশোধ করতে বলেন। হতভম্ব আদিবাসীদের এ ছাড়া উপায় ছিল না। বাবুল রবিদাস নিজেও একজন উকিল এবং এর আগে তাকেও বার সমিতিতে খেতে গিয়ে অপমানের শিকার হতে হয়েছে।
এটা তো খুবই সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বললাম। এ রকম ঘটনা উত্তরবঙ্গে আরও আছে। দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার বারোকনা আদিবাসী গ্রাম। প্রায় ২০০টি আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারের বসবাস এই গ্রামে। ১০ বছর হলো এই আদিবাসী গ্রামের মাঝখানে একটি হাট বসানো হয়। আদিবাসীদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণেই এই হাটে আদিবাসীদের কোনো দোকান বা হোটেল দেখা যায় না। আদিবাসী গ্রামের মাঝে এই হাট হলেও এখানেই তারা বর্ণবৈষম্যের শিকার। হাটের হোটেলগুলোতে আদিবাসীদের খেতে দেওয়া হয় না।
এ রকম ঘটনা আরও অনেক ঘটেছে উত্তরবঙ্গে। রাজশাহীর তানোর উপজেলা বাজারে ঠিক একইভাবে আদিবাসীদের খেতে দেওয়া হয় না। আদিবাসীদের জন্য এখানকার হোটেলগুলোতে দু'নম্বর কাপ-প্লেটের ব্যবস্থা আছে। এখানেও অনেক প্রতিবাদ হয়েছে কিন্তু এই বৈষম্য রয়েই গেছে। পবা উপজেলার রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে বায়া মোড় বাজারের হোটেলেও আদিবাসীদের না খেতে দেওয়ার নজির আছে। উত্তরবঙ্গ ছাড়াও দেশের অনেক স্থানেই এ রকম অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। গত ২২ মার্চ সমকালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল। সংবাদটির সূচনায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের একজন সুইপারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল_ 'হোটেলে ঢুকতে দেওয়া হয় না। আর দিলেও নিম্নমানের কিংবা অব্যবহৃত প্লেট দেওয়া হয়। ভালো সেলুনে আমাদের প্রবেশ নিষেধ। এমনকি ছোটখাটো দোকানে চা খেতে চাইলে বাড়ি থেকে কাপ আনতে বলা হয়।' এসব উদাহরণ কোনোভাবেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের যে চেতনা কাজ করেছিল তার সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না। ভাবতে অবাক লাগে, যখন একজন মানুষকে নয়_ পুরো একটি সম্প্রদায়কে এভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হয়।
এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই এখনও বর্ণবৈষম্য টিকে আছে। আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও এখনও বর্ণবৈষম্য টিকে রয়েছে। সেখানে যখন আমাদের দেশের মানুষ বিভিন্ন কাজে যায় তারাও নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। তখন নিশ্চয় একজন বাংলাদেশি হিসেবে তা আমাদের সবাইকে দুঃখ দেয়। তাহলে কেন আমরা নিজ দেশের আদিবাসী, দলিত, হরিজন জাতিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ জারি রাখব আর তা দেখেও কোনো ব্যবস্থা নেব না?
ananimist@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.