প্রথম হাসি by ফরিদুর রেজা সাগর

আরিফ ভাই বয়সে সবচেয়ে বড় বলে এই মুহূর্তে তাকে কমান্ডার বলে মানতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা মেনেছি বলে তিনি সত্যি সত্যি নিজেকে পুরো কমান্ডার বলে ভেবে বসবেন এটা বুঝতে পারিনি। গত তিন মাসে আমাদের কমান্ডার আমাকে এতটা বকেননি যতটা আরিফ ভাই গত দুই ঘণ্টায় আমাকে বকেছেন।


এমনি আরিফ ভাই খুবই ধীরস্থির মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে অনার্স পড়তেন স্কাউট হিসেবে পুরো পাকিস্তানের জানুয়ারিতে শ্রেষ্ঠ স্কাউট হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন পরপর দুই বছর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু না হলে এই বছরই পেতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ব্লু'র সম্মান।
তবে আরিফ ভাইয়ের দিকে তাকালে এই মুহূর্তে তার পরিচয়টা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ে হাফশার্ট। পরনে লুঙ্গি। এই একই পোশাক অবশ্য আমাদের বাকি সবার। আরিফ ভাই ছাড়াও আমাদের সঙ্গে রয়েছেন স্বপন আর তপন। যমজ দুই ভাই। কে যে স্বপন আর কে যে তপন প্রায়ই ভুল করে বলি। একটা ব্যাপারেই শুধু বোঝা যায়, একজন মাঝে মাঝে নিজের আঙুল দাঁত দিয়ে কামড়াতে থাকে। আরেকজন খামাখাই মাঝে মধ্যে নিজের মাথা চুলকায়। অবশ্য স্বপন মাঝে মাঝে সব কথার মাঝখানে বলে বসে আজব। স্বপন আর তপন বয়সে আমার চেয়ে একটু বড় হলেও ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়ে গেছে বন্ধুর মতো। ফলে ওদেরকে আমি 'তুমি' করেই বলি।
আরিফ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
এখনো সময় আছে_তুমি সিদ্ধান্ত পাল্টাও।
আমি মুখ গম্ভীর করে হাঁটতে থাকি। আরিফ ভাই অসহায়ের মতো স্বপন আর তপনের দিকে তাকিয়ে বলে,
ওকে বোঝাও। নিজেও মরবে। আমাদেরকেও মারবে। আর যাকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছে সে তো না খেয়েই মারা যাবে।
খাবার সময় আমি কাছাকাছি একটা টম্যাটোর ক্ষেত দেখেছিলাম। টম্যাটোর ক্ষেত? এই সময় তোর টম্যাটো খাওয়ার শখ হলো।
আরিফ তাই মাঝে মাঝে রেগে গেলে আপনি-তুমি সব ব্যবহার করে। আমি বললাম, আমার নয়। তবে আমি শুনেছি টম্যাটোর রস খাওয়ানো যেতে পারে।
ওফ্...। এখনো খাওয়ানোর কথা ভাবছ তুমি। নিজেদের খাওয়া আসবে কোথা থেকে_কেমন করে ক্যাম্পে গিয়ে পেঁৗছাব সেটার ব্যাপারে কিছু ভেবেছ?
সত্যি কি আমরা ক্যাম্পে কোনো দিন পেঁৗছাতে পারব না?
কেমন করে পেঁৗছাবে? যুদ্ধের একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়ম না মানলে যুদ্ধে হারতেই হবে।
আমরা তো সব নিয়ম মানার চেষ্টা করেছি।
হ্যাঁ, নিয়ম মেনে রেকি করতে বেরিয়েছিলে। কিন্তু তারপর তোমরা আর কেউ নিয়ম মাননি? এখন ক্যাম্পে পেঁৗছাতে না পেরে দুঃখ করে লাভ আছে?
স্বপন আর তপন আমার দিকে তাকায়। ওরাও কি আরিফ ভাইয়ের মতো সব দোষ আমাকে দিতে চায়? আজ ভোরবেলা নদীর ওপরের ক্যাম্প থেকে আমরা শিমুলিয়া গ্রামে এসেছিলাম রেকি করতে। এই গ্রামে কয়েক দিন আগে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুরো সব বাড়িতেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। শিমুলিয়া গ্রামটা খুব বড় নয়। চলি্লশ থেকে পঞ্চাশটা ঘর। এই গ্রামের মধ্য দিয়ে আসলে যাওয়া যায় গঞ্জে।
নদীর পাশ দিয়ে একটা খাল রয়েছে। সেই খালের ওপর একটা বাঁশের সাঁকো আছে। এই সাঁকোটাই আসলে আমাদের ক্যাম্প আর গ্রামের মধ্যে যোগসূত্র।
ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার সময় বারবার ক্যাম্প কমান্ডার বলে দিয়েছে এই সাঁকোটার মাঝখানে বিস্ফোরক বসানো হয়েছে। ঠিক দুপুর একটায় মুক্তিযোদ্ধারা এই বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটাবে।
আমরা যদি সেই সময়ের মধ্যে ফিরতে না পারি।
তপনের কথা শুনে ক্যাম্প কমান্ডার বললেন,
এরকম কথা চিন্তাও করবেন না। কারণ ওই সময়ের মধ্যে ফিরতে না পারলে সত্যি সত্যি ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটবে।
ব্যাপারটা আমরাও বুঝতে পারছি। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে নিশ্চয়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আশপাশ থেকে বেরিয়ে এসে সাঁকোর সামনে পাহারা বসাবে। কাকপক্ষী কেউ ওপারে যেতে দেবে না।
আমি কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দল থেকে একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, আরিফ ভাই আমার পেছন ফিরে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।
আর কোনো উপায় নেই। আমরা একেবারে শত্রুর হাতে আটকে গেছি।
স্বপন সঙ্গে যোগ করে বলল,
সাঁকোর চারপাশে শুধু পাকিস্তানি সৈন্য।
আমরা যদি পেছনে শিমুলিয়া গ্রামে ফিরে যাই।
আমার কথা শুনে আরিফ ভাই বললেন,
উল্টাপাল্টা কথা বলিস না। শুধু কি সাঁকোর পাশে? এখন চারদিকে ছড়িয়ে আছে পাকিস্তানি সৈন্যরা।
তাছাড়া আমরা যে শিমুলিয়া গ্রামে গিয়েছিলাম সেই খবরও এতক্ষণে তাদের কাছে পেঁৗছে গেছে।
শিমুলিয়া গ্রামে আজ যখন আমরা পেঁৗছেছিলাম তখন আমরা কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। ছোট্ট গ্রাম। কিন্তু একজন মানুষেরও দেখা পেলাম না। দেখা পাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না। দুদিন আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুরো গ্রামটাই জ্বালিয়ে দিয়েছে। শুধু জ্বালিয়ে দেওয়া নয়, যত পুরুষ মানুষ ছিল তাদের সবাইকে পুকুর পারে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। আর গ্রামের মহিলা ও শিশুরা পালিয়ে গেছে কিংবা আগুনে পুড়েছে। এখনো বাতাসে ছড়িয়ে আছে আগুনের পোড়া গন্ধ।
এরই মধ্যে হঠাৎ করে বাচ্চার কান্নার শব্দ। এই প্রেতপুরীতে বাচ্চার কান্নার শব্দ এলো কোথা থেকে? শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে যাই। সামনে খোলা উঠোন। চারপাশের ঘরগুলো সব আগুনে পোড়া। কিন্তু কী আশ্চর্য, উঠোনের মধ্যে একটা ছোট্ট শিশু শুয়ে শুয়ে কেঁদেই চলেছে। পাশে একটা কালো রঙের ছাগল। ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছে। আমি শিশুটার দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আরিফ ভাই আমার কাঁদে হাত দিয়ে ইশারায় বলে,
ওদিকে নয়। সামনে চলো।
এই শিশুটিকে ফেলে চলে যাব?
তাছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
কেন?
এটা যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কেউ কারো জন্য ভালোবাসা, মায়া কিছু দেখায় না।
তাই বলে একটা অবুঝ শিশু_
আমার গলা ধরে আসে। চোখ দিয়ে আগেই পানি পড়ছিল।
আরিফ ভাই সেই চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,
অবুঝ শিশু বলেই ওকে ফেলে যেতে হবে। ওকে আমাদের সঙ্গে নেওয়া মানেই আরেকটা বোঝা।
একটা শিশুকে তুমি বোঝা বলছ? যেখানে সারা দেশের মানুষের জন্য আমরা যুদ্ধ করছি_
সারা দেশের মানুষ আর একটা শিশুর মধ্যে অনেক পার্থক্য।
স্বপন-তপনও এই সময় এগিয়ে আসে সামনে। স্বপন বলে,
শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে গেলে খাওয়াব কী?
না, জানি না। কিন্তু এই রকম একটি শিশুকে একলা ফেলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
পাগলামি করো না।
ততক্ষণে আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়েছি। আর কী আশ্চর্য! কোলে তোলার সঙ্গে সঙ্গে শিশুটি একেবারে চুপ। আমার হাবভাব দেখে বাকি সবাইও চুপ।
সামনের দিকে পথ চলতে চলতে তপন বলল,
এত দেরি হচ্ছে কেন সাঁকোটা আসতে?
ঠিক সেই সময় বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পেলাম। শিশুটি ছোট ছোট হাত দিয়ে আমাকে আরো বেশি করে জড়িয়ে ধরে। আর আরিফ ভাই অসহায়ের মতো মাটিতে বসে পড়লেন। সাঁকোটা আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিল।
এরপর কী ঘটবে তা আমাদের জানা। পাকিস্তানি সৈন্যরা আশপাশ থেকে ছুটে যাবে খালের পারে। পাকিস্তানি সৈন্যদের রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা গেল।
এই শিশুটিকে সঙ্গে না নিলে এতক্ষণে হয়তো আমরা সাঁকোটা পার হয়ে যেতাম।
খামাখা শিশুকে দোষ দিও না। গ্রামটা রেকি করতেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গিয়েছিল।
সেটাও সত্যি। কিন্তু এখন কী হবে?
আরিফ ভাইয়ের মতো আমি নিজেও আসলে চিন্তিত। একটু পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তার আগে যে করেই হোক আমাদের ক্যাম্পে গিয়ে পেঁৗছানো উচিত। সাঁকোটার খুব কাছাকাছি আমরা রয়েছি। সেটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ভেঙে পড়া সাঁকোটার সামনে থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা না সরলে ওপরে ক্যাম্পে যাওয়া সম্ভব না। যে জায়গাটায় আমরা দাঁড়িয়ে এসব কথা ভাবছিলাম সেটা একটা খোলা জায়গা। হঠাৎ করেই আমাদের চোখের সামনে এই সময় একজন লোক এসে দাঁড়ায়। লোকটিও ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। আমাদের অবস্থাও তাই। লোকটির থুতনিতে এক মুঠ দাড়ি। পরনে ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি। গলায় একটা কাগজে উর্দুতে কিছু লেখা। সেটা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু নিচে ছোট করে বাংলায় লেখা আমি বীর বদর। সেকেন্ডের মধ্যে আমরা বুঝে গেলাম, লোকটা বদর বাহিনীর একজন সদস্য। পাকিস্তানি দালাল। আর লোকটিরও বুঝতে বাকি রইল না আমরা কারা? অল্প কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা। লোকটি মুক্তি মুক্তি বলে চিৎকার করে সাঁকোর দিকে এগিয়ে যায়। তপন ওর পিঠে রাখা রাইফেলটা ততক্ষণে হাতে নিয়েছে। আরিফ ভাই রাইফেলটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন,
এখন গুলি করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা এদিকে ছুটে আসবে। বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। ততক্ষণে বদর বাহিনীর সদস্য চোখের আড়ালে চলে গেছে। আরিফ তাই বললেন, এখানে নিরাপদ কোনো জায়গায় আশ্রয় নেওয়া প্রয়োজন।
চারপাশে তাকিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের মতো কোনো জায়গা চোখে পড়ল না। বড় কোনো গাছ নেই। ফসলের ক্ষেত নেই। তারপরও যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার পাশের জমিটা একটু নিচু। সেখানে মাথা নামিয়ে একটু আড়াল হয়ে হয়তো থাকা যেতে পারে। আরিফ ভাই সেইভাবেই আমাদের থাকার নির্দেশ দিলেন। শিশুটা কোনো শব্দই করছে না। আমি জানি, বাকি তিনজনের মনেই প্রশ্ন, শিশুটা আদৌ বেঁচে আছে কি না? কিন্তু শিশুর হাতের আঙুলগুলোর নড়াচড়া আমি টের পাচ্ছি। তবে আশ্চর্য হয়ে আমি ভাবছি, শিশুটি এতক্ষণে একবারও কাঁদেনি। দুধ তো পাওয়া যাবে না। রাত হলে টম্যাটোর রস না পাওয়া গেলেও কোনো না কোনো গাছের পাতার রস খাইয়ে শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ফিসফিস করে কথাটা বললাম। আর আরিফ ভাই বেশ জোরেই বললেন, শিশুটিকে নয়। নিজেদের বাঁচার কথা ভাব। স্বপন-তপন রাইফেল হাতে নাও।
একটু আগে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে আটজন পাকিস্তানি সৈন্য দাঁড়িয়ে। সবার হাতে রাইফেল। সঙ্গে সেই পাকিস্তানি দালাল। উর্দু, বাংলা আর ইংরেজি মিলিয়ে বলছে,
স্যার বিশ্বাস করেন এইখানে চারটা মুক্তি ছিল।
এই খোলা জায়গায় মুক্তি আসবে কোথা থেকে? তুমি নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলে আমাদের নিয়ে এসেছ।
স্যার বিশ্বাস করেন_ক্যাপ্টেন সাহেব, এই যে এইখানটায় উনারা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তাহলে এখান থেকে গেল কোথায়?
পাকিস্তানি সৈন্যরা চারদিকে তাকায়। কিন্তু ততক্ষণে আমার দৃষ্টি আটকে গেছে অন্য জায়গায়। শিশুটিকে আমি এই জায়গায় আলাদা হওয়ার সময় লুঙ্গিটা খুলে ভাঁজ করে দোলনার মতো বানিয়ে আমার হাতের সঙ্গে আটকে নিয়েছিলাম। দরকার হলে যাতে আমি স্বপন-তপনের সঙ্গে রাইফেল ব্যবহার করতে পারি। রাইফেলের কথা ভাবতে গিয়ে শিশুটার কথা বোধ হয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম। লুঙ্গি দিয়ে বানানোর দোলনার ওজন যে কমে গেছে সেটা বুঝতে পারিনি। আমার অন্যমনস্কতার সুযোগে শিশুটি হামাগুড়ি দিয়ে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে। ছয় মাসের শিশুর এটাই বোধ হয় প্রথম হামাগুড়ি। আমি মাথা উঁচু করে শিশুটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই তপন আর স্বপন দুদিক থেকে হাত চেপে ধরে। ওদিকে শিশুটি তখন হামাগুড়ি দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তখনও শিশুটিকে দেখতে পায়নি। মনে মনে প্রার্থনা করছি শিশুটি যেন কোনো শব্দ না করে। কিন্তু শিশুটি শব্দ নয়_প্রচণ্ড জোরে কেঁদে ওঠে। পাকিস্তানি সৈন্যরা শুধু যে ঘুরে শিশুটিকে দেখল তাই নয় রাইফেলের নলগুলো সরাসরি তাক করল শিশুটির দিকে। শিশুটির কিন্তু রাইফেলের নলের দিকে দৃষ্টি নেই। হামাগুড়ি থেকে উঠে শুধু কেঁদেই চলেছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের দলনেতা, দালালটি যাকে ক্যাপ্টেন বলছিল সে রাইফেল নিয়ে এসে দাঁড়ায় শিশুর সামনে। তারপরই প্রচণ্ড অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। ক্যাপ্টেনের দেখাদেখি বাকি সৈন্যরাও হাসতে থাকে। ক্যাপ্টেন হাসি থামিয়ে বলে ওঠে_
শুয়োরের বাচ্চা বাঙালি আমাদের বোকা বানিয়েছিস। এখানে মুক্তি আসবে কোথা থেকে? কাল যে গ্রামে আগুন জ্বালিয়েছি সেই গ্রামের একটা বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে এত দূর এসেছে। না খেতে পেয়ে একটু পরই মারা যাবে। মুক্তিবাহিনী থাকলে এটাকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যেত।
পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে ঠাট্টা!
মুহূর্তের মধ্যে ক্যাপ্টেনের হাতের রাইফেলের নলটা ঘুরে যায় 'আমি বীর বদর বাহিনী' লেখার দিকে। একসঙ্গে গর্জে ওঠে ৮টা রাইফেল।
শালা, আমাদের ঠকানোর চেষ্টা করে?
পাকিস্তানি আটজন সৈন্য একসঙ্গে ফিরে যায় গ্রামের দিকে। যাওয়ার আগে ক্যাপ্টেন বলে, যে মুক্তিরা সাঁকো উড়িয়েছে তারা অনেক দূর চলে গেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা দৃষ্টির বাইরে চলে যেতেই দৌড়ে ছুটে এসে আমি শিশুটিকে কোলে তুলে নিই।
রাইফেলের শব্দ শুনেই শিশুটির কান্না থেমে গিয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্য দেখে শিশুটা জীবনে প্রথম হামাগুড়ি দিয়েছিল। দালাল দেখে কেঁদেছিল। আর গুলির শব্দ শুনে বোধ হয় প্রথম হাসিটা শিশুর মুখে এসেছিল। সেই হাসিটা এখনো শিশুর মুখে রয়ে গেছে। আর হাসিটা দাঁড়িয়ে গেছে তপন, স্বপন আর আরিফ ভাইয়ের মুখেও। কারণ ভাঙা সাঁকোর কাছ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য সরে যাওয়া মানে আমাদের ক্যাম্পে যাওয়ার পথ খুলে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.