সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-রামু ও উখিয়া থেকে ফিরে by মো. আনোয়ার হোসেন

রামু-উখিয়ায় ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতের বিপর্যয়ের পর আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ ও শান্তি মিছিলের আয়োজন করি। সেমিনার ও মুক্ত আলোচনা হয়। সেখানে ছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উৎসাহী অংশগ্রহণ।


সেমিনারে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শেষ পর্বের ছাত্রী ফাতেমা তুজ জোহরা বলে : ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার দুস্থ মানুষের এই মুহূর্তে যা সবচেয়ে প্রয়োজন, তা হলো অর্থ কিংবা প্রাত্যহিক জীবনযাপনের জন্য অত্যাবশ্যক সামগ্রী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষ থেকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার তার এই প্রস্তাব সানন্দে গৃহীত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ভালো সাড়া মেলে তাতে। এসব কাজে সার্বিক সাহায্য ও পরামর্শ দেন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আকন্দ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আহ্বানে শিক্ষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্থ সাহায্যে এগিয়ে আসেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে সারাদেশ থেকে আগত অভিভাবক, ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রী, কর্মচারী, কর্মকর্তারা নিজেদের সাধ্যমতো টাকা-পয়সা দেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রায় দেড় লাখ টাকা সংগ্রহ করে ফেলে। সে অর্থ নিয়ে ২৩ অক্টোবর, ২০১২ তারিখ সন্ধ্যায় আমাদের ২০ জনের দলটি ক্যাম্পাস থেকে সারারাতের বাসযাত্রা শেষে রামুতে যখন পেঁৗছায়, তখন সকাল ৯টা। আমাদের দলে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রী ছাড়াও ছিলেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আহমেদ রেজা। স্থির হয়েছিল, আক্রান্ত পরিবারগুলোকে সংগৃহীত অর্থ ভাগ করে দেওয়া হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অমিত চাকমা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরির জন্য আগেই সেখানে চলে যায়। তাকে বিশেষভাবে বলা হয়েছিল, প্রত্যন্ত এলাকায় আমরা যাব, যেখানে এখনও হয়তো কোনো বা তেমন বেশি সাহায্য পেঁৗছেনি। কেরানির হাট এলাকায় পেঁৗছে অমিতের কাছে জানতে পারি, সরকার ইতিমধ্যে আক্রান্ত এলাকার জনসাধারণের মাঝে প্রাথমিক সহায়তা দিয়েছে। এ কারণে তার প্রস্তাব ছিল, রামু ও উখিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বৌদ্ধবিহারে আমাদের সংগৃহীত অর্থ বণ্টন করা। এ প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত মনে হলো। অমিত ৫টি বৌদ্ধবিহারের তালিকা আমাদের হাতে দেয়_ রামুতে অবস্থিত তিনটি এবং উখিয়া এলাকায় দুটি। পরে আমাদের দলের অন্যতম সদস্য নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মমো রাখাইনের প্রস্তাবমতো রামুতে অবস্থিত আরও ৩টি বৌদ্ধবিহারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
আমরা প্রথমে যাই রামুর প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে। এখানেই ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম হামলা হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর বর্বর হামলার খবর টেলিভিশনে দেখেছি, পত্রিকায়ও পড়েছি। তা ছিল বীভৎস ও ভয়াবহ। ধ্বংসযজ্ঞ ছিল অকল্পনীয়। সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগে যেসব অনুসন্ধান কমিটি হয়েছে, তাদের প্রতিবেদনও পড়েছি। কিন্তু রামু-উখিয়ায় এসে চোখে যা দেখি, তাতে এই উপলব্ধি হয় যে, কত বড় ক্ষতি আমরা করে ফেলেছি। দূর থেকে দেখে তা ধারণা করা একেবারেই সম্ভব নয়। একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু জানালেন, কয়েকশ' বছর ধরেই এ এলাকায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম বৌদ্ধরা বসবাস করছে। কেউ তাদের আক্রমণ করেনি। এসব এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা ক্রমাগত কমে আসছে এবং এখন তারা প্রকৃত অর্থেই সংখ্যালঘু। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীরা তাদের ওপর আক্রমণ করা তো দূরে থাক, কখনও তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করেনি। বরং একান্ত আপনজন হিসেবে সংকটে তাদের রক্ষার জন্যই সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে। অথচ ২৯ সেপ্টেম্বরের ভয়াল রাতে এসব এলাকায়ই একের পর এক বৌদ্ধবিহার এবং বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি আক্রমণের শিকার হয়েছে।
বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র নামের যে বৌদ্ধবিহারে প্রথমে যাই, সেখানে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের উজ্জ্বল সোনালি রঙের গৌতম বুদ্ধের মূর্তি শায়িত। এর ওপর সকালের আলো পড়ায় এক অপরূপ দৃশ্য আমরা অবলোকন করি। বুদ্ধ যেন নিশ্চিন্তে ও শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন। মনে হয় তাঁর ওপর সামান্য আঁচড়টুকুও পড়েনি। কিন্তু চারপাশের দৃশ্য ভিন্ন_ ভিক্ষুদের থাকার স্থান ও আশপাশের বৌদ্ধ বসতি সব ভস্মীভূত। বুদ্ধমূর্তির পেছনে যে ঘরটি ছিল, সেখানে শুধু ছাই আর আগুনে পোড়া ছোট ছোট বুদ্ধমূর্তি। আর রয়েছে দোমড়ানো-মোচড়ানো পোড়া টিন। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যে ঘরে থাকতেন, তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভস্মীভূত কাঠের আলমারির অবশেষ পড়ে আছে। তাতে রয়েছে অতি প্রাচীন কিছু গ্রন্থের ধ্বংসাবশেষ। সম্পূর্ণ পুড়ে যায়নি। হাতে নিয়ে পড়তে চেষ্টা করি। কিন্তু চোখ পানিতে ভিজে আসে। ভাবি, এমন ক্ষতি যারা করেছে, তারা কি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক? ভিক্ষুরা আমাদের শায়িত বুদ্ধমূর্তির পেছনে নিয়ে যান। শক্ত কংক্রিটের মূর্তির পেছনের গায়ে ছোট দরজাটি আক্রমণকারীরা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। এ জন্য তারা ব্যবহার করে শাবল ও গাঁইতি। পুরনো টায়ার তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। মূর্তির ভেতরে সেগুলো ছুড়ে দিয়েছিল তারা। ছড়িয়ে দিয়েছিল পেট্রোল এবং বারুদ। তাতে আগুন দিয়েছিল। গ্রেনেডও ছুড়েছে ভেতরে। সেখানে উপস্থিত একজন বললেন : ওই দুষ্কৃতকারীদের আঘাতের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের বুদ্ধমূর্তি। তাদের হয়তো কল্পনায় ছিল, আফগানিস্তানের বামিয়ান পর্বতের গায়ের বুদ্ধমূর্তি যেভাবে তালেবান কামান দেগে ধ্বংস করেছিল, ঠিক সেভাবেই বিস্টেম্ফারক দিয়ে বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের বৌদ্ধবিহারের মূর্তি গুঁড়িয়ে দেবে তারা। তাদের এ হীন চেষ্টা ব্যর্থ হয়_ ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের মূর্তিটি অক্ষত থাকে। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের হৃদয়ে যে আঘাত, যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তা বড়ই গভীর। গেরুয়া পোশাক পরা বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ছোট শিশুরা আমাদের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তাতে গভীর অসহায়ত্ত।
এ বিহারে প্রবেশের মুখে পল্গাস্টিকের চেয়ারে বসে রয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আক্রান্ত বৌদ্ধরা যেন নতুন কোনো সহিংসতার শিকার না হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই তারা আছেন। তাদের সঙ্গে কথা হয়। বললাম, আমাদের সংখ্যালঘু ভিন্নধর্মাবলম্বীদের রক্ষার দায়িত্ব ছিল আমাদের। আমরা তা করতে পারিনি। তাদের ওপর আর কোনো আক্রমণ যেন কখনও না হয়, সেটা যেন তারা দেখেন।
এরপর আমরা এক-এক করে রামুর 'সোনা জেতবন বৌদ্ধবিহার', জাদিপাড়ায় 'আর্য্যবংশ বৌদ্ধবিহার', কেন্দ্রীয় 'সীমা বৌদ্ধবিহার', 'উ-মংরি (লাল সিং ও সাদা সিং) বৌদ্ধবিহার', 'বড় ক্যাং বৌদ্ধবিহার', উখিয়ার 'প্রজ্ঞামিত্র মহারত্ন (খয়রাতি) বৌদ্ধবিহার' ও সব শেষে পশ্চিম মরিচ্যায় 'দীপাংকুর বৌদ্ধবিহারে' যাই। সর্বত্র ধ্বংসের একই চিত্র। আক্রমণকারীরা এসেছিল দলবদ্ধভাবে। এক পাশবিক উন্মত্ততায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অনেকেরই চেহারা চেনা। কারণ এরা ছিল আক্রান্তদেরই প্রতিবেশী। কিন্তু মুহূর্তেই তারা অচেনা হয়ে পড়েছিল। তাদের আক্রমণে প্রাণ নিয়ে পালান ভিক্ষু এবং সাধারণ বৌদ্ধরা। সেই কত বছর আগে শংকরাচার্যের সময়ে ভিন্ন ধর্মের ক্রোধের শিকার হয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। তাদের তখন আশ্রয় মিলেছিল প্রকৃতির বুকে_ পাহাড়ে ও জঙ্গলে। সেই ক্ষত, সেই ভুল শোধরাতে অনেক সময় লেগেছে। এবার স্বাধীন বাংলাদেশে আবার তাদের জীবন বাঁচাতে চলে যেতে হলো গভীর রাতে জঙ্গলে-পাহাড়ে, প্রকৃতির কাছে। কয়েকটি প্রশ্নের উদয় হয় মনে_ বৌদ্ধবিহারগুলো একটি থেকে অন্যটি বেশ দূরে। কিন্তু ২৯ সেপ্টেম্বরের ভয়াল রাতে প্রায় একই সময়ে সেগুলোতে হামলা হয়। তার অর্থ এই আক্রমণ ছিল পূর্বপরিকল্পিত। শুধু বুদ্ধমূর্তি নয়, আক্রমণকারীরা মানুষের হৃদয়ও ভেঙেছে।
উখিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি আদিল চৌধুরীর বাবা শমসের আলম চৌধুরীর বয়স এখন ৯৪ বছর। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোগী। কয়েক বছর আগে উখিয়ায় তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু আইয়ুব আমলের শুরুতে ১৯৫৮ সালে যৌবনে তাদের বাড়িতে এসেছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এখানে থেকেছেন কয়েকটি দিন। ৬ ছেলেকে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শিক্ষিত করেছেন। এবারে রামু-উখিয়ায় ত্রাণ কাজে অংশ নেওয়া আমার স্ত্রী এ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় মোবাইলে আদিল চৌধুরীর নাম খুঁজে পাই। উখিয়ায় তার সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানালেন এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রের কথা। এক সুগভীর চক্রান্ত চলছে মিয়ানমারের আরাকান এবং সংলগ্ন বাংলাদেশ ভূখণ্ড নিয়ে। ষড়যন্ত্রকারীরা চাইছে এ অঞ্চলে এমন একটি বাফার স্টেট সৃষ্টি করতে, যেটা হবে জঙ্গি ইসলামী রাষ্ট্র। এ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিদেশি শক্তি জড়িত এবং কাজও চলছে অনেক দিন ধরে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা যেমন রয়েছে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণও তাদের লক্ষ্য। জঙ্গি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে তারা সদা সচেষ্ট। এখন মোক্ষম সুযোগ এসেছে তাদের। মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংস আক্রমণ এবং তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে এরা ষড়যন্ত্র করেছে। বৌদ্ধদের পাশাপাশি বাস করা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে মিথ্যা ভিত্তিহীন প্রচারণা চালিয়ে। তারা চায় বৌদ্ধদের সম্পূর্ণ বিতাড়ন করতে, যাতে এ অঞ্চল কেবলই মুসলমানদের হতে পারে। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই ফেসবুকে অসত্য তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের উস্কে দিয়েছে তারা। এ অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নরনারী_ যারা কখনোই অন্যকে আঘাত দেয়নি_ তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হয়েছে। বৌদ্ধ রমণীরা পবিত্র কোরআন শরিফ পদদলিত করেছে_ এমন ভিত্তিহীন অসত্য কথা ছড়িয়ে দিয়েছে মাইকে। এমনিভাবেই চরম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মুসলমান জনগোষ্ঠীর মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে তারা।
উখিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় প্রজ্ঞামিত্র বৌদ্ধবিহারটি পাহাড়ি ঝরনার ওপারে অবস্থিত। একটি নড়বড়ে সেতু অতিক্রম করে সেখানে গিয়েছিলাম। আক্রমণকারীরা এ পথেই এসেছিল। তারা দূরের নয়, কাছের মানুষই ছিল। তরুণ ভিক্ষু বলেন, সবাই তো এতদিনের চেনা-জানা। সবশেষে দীপাংকুর বৌদ্ধবিহারে যখন পেঁৗছি তখন রাত হয়ে গেছে। সেখানে আমাদের সঙ্গে বড়দের পাশাপাশি কিছু শিশু-কিশোরও জড়ো হয়েছিল। এরা এখানকার মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়ে। ভিক্ষু একান্তে বললেন, এসব ছোট শিশুও নাকি কেউ কেউ বলছিল : পুলিশ-সরকার কতদিন পাহারা দেবে? এ থেকে বুঝতে পারি, সাম্প্রদায়িকতা কত গভীরে প্রোথিত হয়েছে। এটা উপড়ে ফেলা তো সহজ কাজ নয়। এ জন্য পরম ধৈর্য, যত্ন ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া তো অসহায় বৌদ্ধদের বাঁচানো সম্ভব হবে না। যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরাময়ের জন্য কেবল সরকারি পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। কেবল সহমর্মিতা ও সংবিধানে কার্যকর অসাম্প্রদায়িকতা যুক্ত হলেই চলবে না। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক হতেই হবে। তাও যথেষ্ট নয়। আমাদের আরও গভীরে কাজ করতে হবে। যথার্থ গণতান্ত্রিক, মানবিক এবং অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে হবে শিশু থেকে বয়স্ক সব মানুষের মধ্যে। এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যা যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে আমাদের। আর এ জন্য যে পথ চলতে হবে, তার পুরোধা শক্তি হিসেবে থাকতে হবে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিকে। আওয়ামী লীগকে থাকতে হবে একেবারে সামনে।
দীর্ঘমেয়াদি এক রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে নিরন্তরভাবে মানুষকে বোঝাতে হবে_ তাদের মন থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প-বিদ্বেষ দূর করে দিতে হবে। লাগাতার সভা-সমিতি, ঘরোয়া বৈঠক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি চালিয়ে যেতে হবে। সব প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তারাই স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের বোঝাবেন_ মানুষের জয়গান গাইবেন। শিশুরা যেন ভুল পথে না চলে, তা নিশ্চিত করবেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রকে নির্মমভাবে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে ওই দুষ্কৃতকারীদের ওপর, যারা ষড়যন্ত্র করে চলেছে জঙ্গি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য; যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের জন্য কাজ করছে বিদেশি শক্তির পক্ষ হয়ে। এতদঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ ও প্রশাসনকে কাজ করতে হবে সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সিক্ত হয়ে। তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অসহায় মানুষদের প্রতি। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে এদেশের মানুষ চরম আত্মত্যাগ করেছিল যে বাংলাদেশের জন্য, সেই অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশ আমরা চাই। আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ও বাঙালিদের আজ এ উপলব্ধিতে আসতে হবে যে, ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে আমরা সবাই এই বাংলাদেশের সন্তান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ অক্টোবর ২০১২ তারিখে প্রতিবাদী আলোচনা সভায় আমরা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী আলোকিত মানুষদের আমন্ত্রণ করেছিলাম। তখন জানতে পারি, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ৮২টি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও নৃগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করছে। তাদের সবার নাম সংগ্রহ করেছি। আমরা বলেছি_ আমরা সবাই এদেশের সন্তান। এই শস্যশ্যামলা সুন্দর বাংলাদেশকে তার সব সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত করতে হবে। এ ভূখণ্ড হবে বহুত্ববাদী। এখানে শুধু বাঙালি বা মুসলমান নয়, সবাই থাকবে সমান অধিকার নিয়ে। কেবল তখনই আমরা বলতে পারব যে, বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হয়েছে।
রামু-উখিয়ায় সহিংসতার কারণে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, সেটা অবশ্যই মুছে ফেলতে হবে। এ ক্ষত গোটা বাংলাদেশের হৃদয়েই হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে গত ৪১ বছরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দুঃশাসনে নানা অসঙ্গতি সংবিধানে, রাষ্ট্রে, সমাজ-জীবনে, সংস্কৃতিতে এবং মানুষের বিশ্বাসে সৃষ্টি হয়েছে, সেসব অসঙ্গতিও দূর করতে হবে। এ কাজটি করার জন্য তরুণ প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে তারা এগিয়ে এসেছে। যেমন এসেছে মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। এ কারণেই তাদের বলা হয় আশা-ভরসার স্থল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৪ জন ছাত্রছাত্রী রামু-উখিয়ায় গিয়েছিল। এদের সবাই পাহাড়ি। তবে সমতল ভূখণ্ডের শিক্ষার্থীরাও ছিল এই শুভ উদ্যোগের সঙ্গে। রামু-উখিয়ায় যাওয়ার সময় আমাদের সেই সব পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীর চোখে-মুখে দেখেছি গভীর হতাশা ও বেদনার ছাপ। কিন্তু ৮টি বৌদ্ধবিহারে নিবিড় পরিভ্রমণের পর যখন জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে ফিরে আসছি, তখন তাদের চেহারায় নতুন আশাবাদ দেখতে পেয়েছি। তারা বুঝতে পেরেছে যে, সবকিছু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি এখনও আশপাশেই রয়েছে। এ শক্তি অবস্থান করছে প্রধানত সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই। যে কোনো কঠিন সময় মোকাবেলায় তাদের পাওয়া যাবে সামান্য ডাক দিলেই।

অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.