বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার কোনো ব্যত্যয় হয়নি: ইআরডি- দীর্ঘ ছুটিতে যেতে রাজি মসিউর

প্রধানমন্ত্রীর অর্থ-বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। তিনি গতকাল রোববার ছুটি শেষে কাজে যোগ দিয়েছেন বলে আবারও জানালেন। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) অর্থমন্ত্রীর পক্ষে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার কোনো ব্যত্যয় হয়নি।


অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও গতকাল পদ্মা সেতু নিয়ে কথা বলেছেন। তবে মসিউর রহমানের কাজে যোগ দেওয়া নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ইআরডি বিবৃতি দেবে বলে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় ইআরডি বিবৃতি দিলেও সেখানে সরাসরি মসিউর রহমানকে নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি।
এদিকে, গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মসিউর রহমানকে প্রায় চার ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়ে থাকলে তিনি দীর্ঘকালীন ছুটিতে যেতে সম্মত আছেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্ত চলাকালে মসিউর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ছুটিতে পাঠানোর শর্ত দেয় বিশ্বব্যাংক। এর অংশ হিসেবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ‘ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজার’ মসিউর রহমানকে এক মাসের ছুটিতে পাঠায় সরকার। ১ নভেম্বর ছুটি শেষে তিনি আবার কাজে যোগ দেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পদ্মা সেতুর বিষয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও খোঁজখবর নেওয়া হয়।
এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে আলোচনার পর গতকাল সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হলেও তাতে মসিউর রহমান সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। এ বিষয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে সদ্য বিদায়ী ইআরডি সচিব ও ভারপ্রাপ্ত বিশেষ কর্মকর্তা (ওএসডি) ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘তিনি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা। তাঁর বিষয়ে কথা বলতে আমি উপযুক্ত ব্যক্তি নই।’
ছুটি শেষে মসিউর রহমান যোগদান করেছেন কি না, এই সম্পর্কে ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘এই বিষয়ে আমার কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নেই। তাঁর যোগদানের বিষয় স্পষ্ট নয়।’ তবে তিনি জানান, এটা (প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টার ছুটিতে যাওয়া) একটি শর্ত। এই শর্তের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। সরকারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বিবৃতিতে যা আছে: ইকবাল মাহমুদ বিকেলে তাঁর কার্যালয়ে অর্থমন্ত্রীর পক্ষে বিবৃতিটি সাংবাদিকদের পড়ে শোনান। বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে আবার সম্পৃক্ত হয়েছে। সে জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিস্তর আলোচনার পর একটি সমঝোতা হয়। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, আজ পর্যন্ত তার কোনো ব্যত্যয় হয়নি। সরকার বিশ্বব্যাংককে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে একটি তদন্ত বিশেষজ্ঞ দল দুদকের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমাদের ধারণা, তদন্তের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তারা ইতিবাচক ধারণায় উপনীত হয়েছে। দুদক নিজস্ব গতিতে তদন্তকাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আশা করা হচ্ছে, এই মাসেই বিশ্বব্যাংকের আরও একটি দল প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনার জন্য আসবে। এই দলে অন্য দাতা সংস্থাও অংশ নেবে। এই অর্থবছরেই পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড শুরু হবে।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য: সকালে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের ছুটিতে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান আগের মতোই আছে। এই উপদেষ্টার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের যে সমঝোতা, তার কোনো ব্যত্যয় হয়নি, হবেও না।
অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। সেতু প্রকল্প দ্রুত কার্যকর করা এখন সময়ের ব্যাপার। সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল এম গুয়েরেরো চলতি মাসেই ঢাকায় আসবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অর্থমন্ত্রী। এক বছর দুই মাস আগে একই ব্যাপারে ইসাবেল ঢাকায় এসেছিলেন বলে স্মরণ করেন মুহিত।
অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ব্যাপারে গত জুন থেকেই কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যা বাকি ছিল, তাও নেওয়া হয়েছে পরে। এখন আর প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো জটিলতা নেই।
ছুটি শেষে মসিউর রহমান কাজে যোগ দিয়েছেন কি না, অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে পাশে থাকা সদ্য বিদায়ী ইআরডিসচিব জবাব দেন। ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘দয়া করে পীড়াপীড়ি করবেন না। এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।’
তবে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট আসার সঙ্গে পদ্মা সেতুর কোনো সম্পর্ক নেই। আর তাঁর আসাটা এখনো অনিশ্চিত।
দুদকে মসিউর: জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুদকের কার্যালয়ে মসিউর রহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দুদকের সঙ্গে যে আলাপ-আলোচনা, তা গোপনীয় বিষয়। দুদক বাংলাদেশের আইনের অধীনে তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান। দুদকের অধিকার আছে, ক্ষমতা আছে এবং যেকোনো লোক যদি তার নামে কোনো অপরাধ থাকে, সে আসবে এখানে, সে তার বক্তব্য দেবে। এটা দেশের আইন এবং মনে করি আমাদের সবারই আইন মেনে চলা উচিত।’
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ প্রসঙ্গে মসিউর রহমান বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক কী নালিশ করেছে না-করেছে, আমি আপনাদের মতো পত্রিকা পড়েছি। যদি বিশ্বব্যাংক আপনাদের কাছে কিছু দিয়ে থাকে, আমি আপনাদের অনুরোধ করব, আপনারা কাগজে সেটা ছাপান। কারণ, এই অপবাদ বা এই দুর্নামটি কী, এটা কেউ জানে না, আমি নিজেও জানি না। আপনারা যদি জানেন, আপনারা সেটা কাগজে ছাপিয়ে দেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি বিশ্বব্যাংক কিছু না দিয়ে থাকে, এই প্রচারে দেশের যে দুর্নাম হচ্ছে, যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা থেকে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আপনাদের কাছে, সবার কাছে আবেদন, যদি অপপ্রচার বা মিথ্যা হয়, সেটা থেকে সরে এসে আপনারা সত্যি কথাটা বলেন।’
ছুটি শেষে কাজে যোগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ছুটি নিয়েছি, ছুটি শেষে ফিরে এসেছি। যদি বিশ্বব্যাংক এবং সরকারের ভেতরে এমন কোনো কিছু হয়ে থাকে যে আমার আরও দীর্ঘদিন ছুটিতে যেতে হবে বা ছুটিতে থাকতে হবে, আমি থাকব। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের যে সমঝোতা হয়েছে, তার ভিত্তিতে আলোচনায় যাতে কোনো বাধা সৃষ্টি না হয়, আমি সে কাজটি করব।’
মসিউর রহমানকে গতকাল জিজ্ঞাসাবাদ করেছে অনুসন্ধান দলের প্রধান ও দুদকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত দল। দুদক সূত্রে জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় মসিউর রহমান বেশির ভাগ প্রশ্নের ক্ষেত্রেই জানেন না, মনে নেই—এ জাতীয় উত্তর দিয়েছেন। তবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ নিয়ে বারবার কমিটি গঠন সন্দেহজনক কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি এর দায় সেতু বিভাগ ও মন্ত্রীর বলে জানিয়েছেন। পুরো কার্যক্রমে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলেও একমত হন তিনি।
এ ছাড়া, গতকাল দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, এখন পর্যন্ত মামলা করার মতো কিছু পায়নি দুদক। তবে তদন্ত চলবে বলে তিনি জানান।

No comments

Powered by Blogger.