চালচিত্র-ক্ষমতার রাজনীতি ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার দায় by শুভ রহমান

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সদ্যসমাপ্ত ও বহুল আলোচিত ভারত সফর দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার একটা বড় দায় পরবর্তী সরকারের ওপর বর্তাবে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশে আগামী দিনে ক্ষমতাসীন পক্ষকে অপরিহার্যভাবেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।


এর আর কোনো ব্যত্যয় বা বিকল্প থাকবে না।
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ধরনের দীর্ঘ শাসনকাল থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪০ বছর পরও দেশবাসীকে ভারতীয় জুজু দেখানোর খেল কার্যত এবার খতমই হয়ে গেল।
যাঁরা নিজেরাই এই খেলায় মেতে থেকেছেন, কথায় কথায় দেশ বিক্রির ধুয়া তুলেছেন, তাঁদের এখন আর মুখ থাকবে না সে ধুয়া ধরার। বাংলাদেশ একটা ভয়ংকর নেতিবাচক রাজনীতির দীর্ঘপক্ষ ঈগলের কালোছায়া থেকে মুক্ত হলো। সেদিক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে নির্মল থাকবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রাজনীতির ভুল শিক্ষার সেঁকো বিষ পান করানো হবে না। দেশের সত্যিকার শত্রু-মিত্র চেনার ক্ষেত্রে তাদের বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করা হবে না। করা যাবে না।
বিরোধী নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন ও তাঁর ১৮ দলীয় জোট আগামী দিনে নেতিবাচক 'ইন্ডিয়া কার্ডে'র বদলে ইতিবাচক 'ইন্ডিয়া কার্ড' খেলে ভারতপন্থী বলে পরিচিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কতটা লাভবান হতে পারবেন এবং ক্ষমতা করায়ত্ত করতে পারবেন, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। কিন্তু বেগম জিয়া এবারের ভারত সফরের মাধ্যমে এই দেশটির যে ইতিবাচক ভবিষ্যৎ রচনার কুশলী কারিগর হয়ে থাকলেন, এ দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাস সে জন্য তাঁকে সাধুবাদ দেবে। তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হয়েও নতুন বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ঐতিহাসিক রূপকার হয়ে থাকলেন। বেগম জিয়া গত শনিবার ঢাকায় ফিরেছেন। তার আগে এক সপ্তাহের সফরের প্রথম তিন দিন তাঁর প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ও বিরোধী নেতা সুষমা স্বরাজসহ যেসব ভারতীয় শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, শুধু তাঁদের সঙ্গে আলোচনার পরই তাঁকে ফিরে আসতে হলে তাঁকে দুই দেশের নতুন মাত্রার সম্পর্কের পূর্ণাঙ্গ রূপকার বলা যেত না। ফেরার দিন, অর্থাৎ শনিবার সকালে দীর্ঘকালের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা, বাণিজ্য ঘাটতি, শান্তি ও নিরাপত্তা, টিপাইমুখসহ বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে এক ঘণ্টা আনুষ্ঠানিক আলোচনাই তাঁকে সে পূর্ণতা এনে দিয়েছে। অন্য নেতাদের সঙ্গে একই বিষয়গুলোয় তাঁর আলোচনা হলেও রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সেসবেরই আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছাড়া তাঁর বর্তমান 'মিশন' ও অর্জন বলতে গেলে অসম্পূর্ণ থেকে যেত। অবশ্য, কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা হয়তো এর পরও বলবেন, ভারতীয় রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক 'চাবির গোছার রক্ষক' ক্ষমতাসীন ইউপিএ ও জাতীয় কংগ্রেস নেতা সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পরও সাক্ষাতের ব্যর্থতায় তাঁর মিশনের খানিকটা ব্যর্থতা কিন্তু থেকেই গেল।
সে যাক, নতুন মাত্রার সম্পর্কের যে দ্বার উদ্ঘাটন বিরোধী নেতা বেগম জিয়া এ সফরে করে এলেন, তা অভ্রান্তভাবে শুধু তাঁকে মহিমান্বিত ও ক্ষমতারোহণের ব্যাপারে আশান্বিত করবে, তা-ই নয়, এর ফলে ক্ষমতালিপ্সার ঊর্ধ্বে উঠেই বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির ধারকদের বেগম জিয়ার প্রদর্শিত পথেই হাঁটতে হবে। বৃহত্তম প্রতিবেশীর সঙ্গে সব অমীমাংসিত ইস্যু অক্লান্তভাবে আত্মমর্যাদা ও সমতার ভিত্তিতেই নিষ্পত্তির চেষ্টা করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতিবাচক রাজনীতি নিয়ে আসলে বেশি দূর এগোনো যায় না। কোনো দায়িত্বশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের সোপান গড়ে তোলা যায় না। নেতিবাচক রাজনীতি কখনোই এ দেশ ও গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই কখনো শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার সহায়ক হতে পারে না। আজ যে বৃহত্তম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সব অমীমাংসিত সমস্যা জিইয়ে রয়েছে, তাতে দেশ ও দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল, কারো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনমান উন্নত হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হচ্ছে না। সার্ক স্থবির ও অকার্যকর হয়ে রয়েছে। সার্কের ১৫০ কোটি মানুষের জীবনমান আশানুরূপ উন্নত হতে পারছে না। পক্ষান্তরে পূর্ব এশিয়ার আসিয়ান জোটের ১০টি দেশ পারস্পরিক সহযোগিতা, সৌহার্দ্য ও স্থায়ী বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকায় এবং কোনো রকম নেতিবাচক রাজনীতির আশ্রয় না নেওয়ায় তাদের উন্নতি, অগ্রগতি অবাধ ও দুর্বার। বেগম জিয়ার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরের অর্জনকে আমরা তেমন সুদূরপ্রসারী ফললাভের সম্ভাবনাময় বলেও ভাবতে পারি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটাও বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বরাবর একটা তূষ্ণীভাব, উদার মনোভাবের অভাব এ দেশে বিরোধী রাজনীতির ইতিবাচক রাজনীতির পথে হাঁটার প্রতিবন্ধক হয়ে থেকেছে। এটা গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিপক্বতারও অভাব। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাব, জরুরি জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নগুলোতে ক্ষমতাসীন দল বা জোট সব সময়ই বিরোধী দলের প্রতি যথেষ্ট উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়ে তাদের কাছে টানার এবং ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণে স্বাগত জানিয়েছে ও উৎসাহ জুগিয়েছে।
সবারই জানা আছে, বিজেপিনেত্রী সুষমা স্বরাজের কী উৎকট বিরোধিতাকে জয় করে বিদেশিনী সোনিয়া গান্ধীকে ভারতের জাতীয় সংগঠনের নেতৃত্ব অর্জন করতে হয়েছিল। সহনশীলতা ও উদারতাই ছিল তাঁর অস্ত্র।
এখানে বরাবর অবস্থাটা তার বিপরীতেই ঘটে এসেছে। বৈরিতা ও কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতির নামে। গত বছর সেপ্টেম্বরে ড. মনমোহন সিং প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এলে বিএনপি পূর্বাহ্নে যতই হরতাল দেওয়ার কথা বলে থাকুক, সফর অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় হরতাল দূরে থাক, তাঁকে স্বাগতই জানিয়েছে এবং কোনো রকম বিরোধী কার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত থেকেছে। টিপাইমুখে যৌথ জরিপ দল পাঠানোর প্রস্তাবও দিয়েছে বিএনপি। সেখানে যদি ক্ষমতাসীন মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ বিরোধী দল বিএনপিকে জরুরি জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নগুলো মিলিতভাবে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানাত এবং উদ্যোগ গ্রহণ করত, তাহলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেমন ইতিবাচকতার সূচনা হতো, তেমনি সীমান্ত সমস্যা, ছিটমহল, তিস্তা, টিপাইমুখ, বাণিজ্য ঘাটতি, ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট ইত্যাকার অনেক প্রশ্নেই আমাদের দেশের সাফল্যের পাল্লা ভারী হতো। গণতান্ত্রিক রাজনীতির পতাকাবাহী ভারত যে বস্তুত বিরোধীয় বিষয়গুলোর নিষ্পত্তিতে কোনো দল, ব্যক্তি বা সরকারের সঙ্গে খণ্ডিত মতৈক্য নয়, সমগ্র দেশ ও জাতির সঙ্গেই সহমত কামনা করে, সেটা এবার বেগম জিয়ার আমন্ত্রণ, তাঁর সঙ্গে সমমর্যাদা ও সমান গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনার ব্যবস্থা করে চোখে আঙুল দিয়েই যেন দেখিয়ে দিল। বেগম জিয়ার প্রতি ভারতের সার্বিক আচার-আচরণকে ভারতের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন বলে মনে করা হচ্ছে, বাস্তবে কিন্তু সেটাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা মাত্র। ভারতের মতো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতির পতাকা সমুন্নত রেখেই আমরাও এ দেশে সংসদীয় রাজনীতিকে সত্যিকার ফলপ্রসূ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর করে তুলতে পারব।
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, ভারত একটা বড় রকম ঝুঁকিই গ্রহণ করল। জেনে-শুনে বিষপানের মতোই উগ্র সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি কানেকশনের এবং বাংলাদেশের মাটিকে নানাভাবে ভারতবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যবহৃত হতে দেওয়ার ব্যাপারে সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তির প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করল। এ রকম পরীক্ষামূলক পদক্ষেপে ভারতের সচেতন জনগণ ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট উদ্বিগ্নই বোধ করতে পারে। ভারতের কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য পরিশেষে তা কোনো রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড না-ও বয়ে আনতে পারে। তার পরও ভারত বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে এভাবে ঝুঁকি গ্রহণ করে বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতা সুপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। আমরা এই ঐতিহাসিক ভারতীয় পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই।
শুধু ইতিবাচক, গঠনমূলক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা যে গণতন্ত্রকে কতদূর ফলপ্রসূ করে তুলতে পারে, আজ যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তার বড় রকম সাক্ষ্য রেখে দিচ্ছে। কোনো বৈরিতা নয়, শুধু যুক্তি, সহনশীলতা মেধা ও বুদ্ধির দীপ্তি আর উদারতাই নির্বাচনী প্রচারণায় ডেমোক্রেটিক প্রার্থী ওবামাকে প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান প্রার্থী রমনির দুর্গে কিভাবে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে, রমনির রিপাবলিকান সদস্যদের কেউ কেউ নির্বাচনের আগেই প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ওবামার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন, তা দেখে গণতান্ত্রিক বিশ্ব চমৎকৃত।
সারা বিশ্বেই সেদিক থেকে আজ উদারতা ও সহনশীলতারই সুবাতাস বইছে। সহিংসতা, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা- সবই অতীতাশ্রয়ী ব্যাপার ও তা সর্বতোভাবে পরিতাজ্য।
আমরা আগেও বলেছি, বিএনপি সংসদ বর্জন করে চললেও সংসদে যাবে না, এ কথা যেমন কোনোদিনই বলেনি, তেমনি সংসদীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমেই মাত্র ক্ষমতার পালাবদল হবে বলে সব সময় বিশ্বাস করে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখা ও জোরদার করার স্বার্থেই তাই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার প্রতি সব ধরনের অহেতুক বৈরিতার অবসান ও সব জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা ও অবস্থান গ্রহণে সম্পূর্ণ উদার ও আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হওয়াই হবে ক্ষমতাসীন দল ও জোটের করণীয়। দেশবাসী দেখতে চায়, আগামী দিনে ভারত সফর প্রত্যাগত নবচেতনায় উজ্জীবিত বিরোধী নেতাকে ক্ষমতাসীনরা অসূয়াবিহীনভাবে বরণ করে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার দায় কাঁধে তুলে নিয়েছে।

০৪.১১.২০১২

No comments

Powered by Blogger.