সুখী মানুষের দেশে অসুখী মানুষ by জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া

বিগত ৩ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের বেসরকারি সংস্থা নিউ ইকোনমিকস ফাউন্ডেশন তাদের হ্যাপি প্লানেট ইনডেক্স শীর্ষক তালিকায় বাংলাদেশকে বিশ্বের ১১তম সুখী দেশ বলে উল্লেখ করে। ২০১২ সালে ১৬১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ৫৬ দশমিক ৩ পয়েন্ট নিয়ে ১১তম অবস্থানে আছে।


এটা বাংলাদেশিদের জন্য অবশ্যই খুশির খবর। এ সংস্থাটি মানুষের গড় আয়ু, সুখ-সমৃদ্ধি এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পরিবেশগত প্রভাব ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে সুখী দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে বলে জানা যায়।
কিন্তু এই সুখী দেশের তালিকা বের হওয়ার তিন-চার দিন আগে বাংলাদেশের কিছু মানুষ অত্যন্ত অসুখী অবস্থায় পতিত হয়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পবিত্র মধুপূর্ণিমা ছিল। ওই দিন সন্ধ্যায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা বৌদ্ধবিহারগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধু দান করছিলেন। এই মধুদান উৎসব শেষ হওয়ার পর পরই কক্সবাজার জেলার রামুতে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করা শুরু করে। বিক্ষোভ শেষে রাত ১২টা থেকে তারা দল বেঁধে শত বছরের পুরনো বৌদ্ধবিহারগুলো জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে। রাত ৪টার মধ্যে সন্ত্রাসীরা রামু উপজেলার বহু বছরের পুরনো বৌদ্ধবিহার ও চারটি বৌদ্ধপল্লীতে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে। যে আলোকিত মানুষটি শিক্ষা দিয়ে গেছেন অহিংসা পরম ধর্ম, সব জীবে দয়া করো। জগতের সব প্রাণী সুখী হোক। তাঁর অনুসারীদের শিকার হতে হলো এক উন্মুক্ত হিংসার। প্রবল হিংসার আগুনে তাদের মন্দির পুড়ল, ঘরবাড়ি জ্বলল, লুট হলো সম্পদ, অহিংসার প্রতীক গৌতম বুদ্ধের মূর্তিও ভাঙচুর করল তারা।
ওই দিন যে ঘুমন্ত শিশুটির ঘুম ভেঙে গেছে শত শত মানুষের চিৎকারে, উদ্বিগ্ন মা যাকে কোলে করে আঁচলের তলে নিয়ে ছুটেছেন জঙ্গলের দিকে, সেই জঙ্গলে যাদের কেটেছে ভয়ার্ত প্রহর, সে রাতে যেসব কিশোর-কিশোরী নিকটবর্তী ধানক্ষেত বা জঙ্গলে রাত কাটিয়েছে, যারা দূর থেকে শুনেছে নারকীয় চিৎকার আর দেখেছে আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা- তারা তা ভুলতে পারছে না। শত বছরের পুরনো বৌদ্ধবিহার, বুদ্ধমূর্তি, ত্রিপিটক গ্রন্থ, বুদ্ধধাতুসহ অনেক অমূল্য সম্পদ জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এই বৌদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে আরো পুড়ে গেছে বাঙালি সংস্কৃতিও। দিনের বেলা ফিরে এসে তারা দেখল তাদের ঘরবাড়ি, ধান-চাল, কাপড়চোপড় ও অন্যান্য সামগ্রী পুড়ে শেষ। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গৈরিকবসন ও ভিক্ষাপাত্রটিও পুড়ে গেছে। পুড়ে গেছে ছোট শিশুটির খেলনা পুতুল, শিক্ষার্থীদের বইপত্র। গুরুজনরা তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে পারছেন না। পারছেন না তাদের ভয়ভীতি কাটিয়ে স্কুলে পাঠাতে। তাদের কাছে অনেক দিনের আপন মানুষগুলো যেন হঠাৎ অচেনা হয়ে গেল। তাদের এখন দেখলে ভয় হয়। এই নারকীয় তাণ্ডবে বৌদ্ধরা হতবাক। এ বিভীষিকা তারা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা বৌদ্ধদের কিছু করল না, অথচ স্বাধীন দেশে আপন মানুষের এই পৈশাচিক রুদ্রমূর্তি তাদের ভয়ার্ত করে তুলছে। তাই এই বৌদ্ধ জনপদের মানুষ কিভাবে নিজেদের সুখী ভাবতে পারবে।
শনিবার রাতভর এই বর্বরতা ঘটানোর পরদিন রবিবার দুপুর থেকে টেকনাফ, উখিয়া উপজেলার বৌদ্ধবিহার, বৌদ্ধবসতিগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। টেকনাফ উপজেলার বৌদ্ধবিহার, বৌদ্ধবসতি এবং হিন্দু গ্রাম ও হিন্দু মন্দিরেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সন্ধ্যার পর একাধিক বৌদ্ধবিহারে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। একই অভিযোগে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার লাখেরা ও কালারপুল গ্রামের দুটি বৌদ্ধবিহার ও একটি হিন্দু মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এসব জনপদের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অবস্থাও বিধ্বস্ত রামুর মানুষের মতো। রাতের বেলা মানুষজন লুকিয়ে আত্মরক্ষা করে সকালবেলা দেখতে পায়, চারদিকে দগ্ধ ছাই, বাতাসে পোড়া গন্ধ ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই। খোলা আকাশের নিচে তাদের জীবন যাপন করতে হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে, রৌদ্র তাপে দগ্ধ হয়ে তাদের চোখে এখন অন্ধকার। এসব মানুষের চোখে-মুখে এখনো আতঙ্ক। কাজেই সুখের দেশে এসব মানুষ কিভাবে সুখে থাকবে। এ আগুন, এ বেদনা ও এ নারকীয় ধ্বংস দেখে অন্য বৌদ্ধরা এত দুঃখিত, মর্মাহত যে তাদের মনে সুখী জীবনের কোনো অনুভূতি প্রকাশ পায় না।
রামুতে যখন আগুন জ্বলছে, সাদাচিং, লালচিং, চেরাংঘাটা, বারাকাং বৌদ্ধবিহার, মৈত্রী বিহার, সীমা বিহার, জাদিপাড়া বিহার, পূর্ব মেরংলোয়ার বৌদ্ধ জনবসতি এবং উখিয়া, টেকনাফের বৌদ্ধবিহার ও বাড়িঘরগুলো যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে, তখন নিশ্চয়ই সেসব হিংস্র মানুষ সুখী হয়েছে। রামু-উখিয়ায় যে শিশুটির চোখের সামনে তার বৌদ্ধমন্দির ধূলিসাৎ হয়ে গেল, বাড়িঘর, তার পাঠ্যপুস্তক পুড়ে গেল, বাঁচার শেষ সম্বল লুট হয়ে গেল, তার নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতীক মা-বাবার পরাজিত অসহায়ত্ব প্রকটভাবে দেখা দিল- তারা কোথায় সুখশান্তি খোঁজে পাবে এ দেশে। গভীর বেদনা উৎসারিত কান্না আর নির্বাক চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া তাদের আর কী আছে? জীবন ধারণের ন্যূনতম উপকরণগুলোও যদি না থাকে, তাহলে সুখী হবে কিভাবে?
এ দেশে বহুদিন থেকে পার্বত্য জেলাগুলোতে পাহাড়ি মানুষ ও আদিবাসীদের জীবনে সুখ কেড়ে নেওয়ার মতো একের পর এক ঘটনা ঘটছে। সেটেলার নামক কিছু ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র লোকদের নিয়ে আদিবাসীদের জায়গাজমি ও বাড়িঘর দখল করা হচ্ছে। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ চালু করার পর আদিবাসীদের জমি, বসতবাড়ি অথৈই পানির নিচে তলিয়ে গেলে তারা পাহাড়ের শীর্ষে উঠে যায় এবং গভীর জঙ্গলের দিকে গিয়ে বাড়িঘর নির্মাণ করে। নব্বইয়ের দশক থেকে সরকারি সহযোগিতায় পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের হত্যা, লুণ্ঠন ও জোর করে জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে। শান্তিচুক্তি করেও তাদের শান্তি মিলছে না। এই আতঙ্ক নিয়ে আদিবাসী বৌদ্ধরা কিভাবে সুখে থাকবে?
কিছু দিন আগে সাতক্ষীরায় হিন্দুদের ওপর যে হিংস্র আক্রমণ হলো, হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিতে পারলে তাদের ভিটেমাটি, পুকুর, দিঘি, জমিজমা হস্তগত করা যাবে- এই হচ্ছে মূল লক্ষ্য।
আসুন, তবু আমরা সবাই সুখ কামনা করি। আমাদের সুখ বাধাবিঘ্নমুক্ত হোক। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মুখে সর্বদা উচ্চারিত হোক, 'জগতের সব প্রাণী সুখী হোক।'

লেখক : সরকারি কলেজের সাবেক
অধ্যক্ষ, প্রাবন্ধিক এবং উখিয়া উপজেলার অধিবাসী
jitenbarua2012@gmail.com.

No comments

Powered by Blogger.