পরীক্ষা ছাড়াই আমদানি দেশি ফলেও ফরমালিন by রাজীব আহমেদ

বিদেশি ফলে ফরমালিন মেশানো থাকে, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তা ধরাও পড়ছে, ফরমালিনের বিষক্রিয়া সম্পর্কে মানুষ সচেতন হচ্ছে- এসব তথ্য ছাপিয়ে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে সর্বশেষ যা জানা গেছে, তা আরো ভয়াবহ।


তথ্যটা হলো- বিদেশ থেকে যখন নানা রকম ফল আমদানি করা হয়, তখন বাংলাদেশের কোনো বন্দরেই তা পরীক্ষা করে দেখা হয় না যে ওই সব ফলে ফরমালিন মেশানো আছে কি নেই। অথচ বাংলাদেশ থেকে যখন কিছু ফল রপ্তানি করা হয়, তখন তা কড়াকড়িভাবে পরীক্ষা করে, ছাড়পত্র দিয়ে তবেই পাঠাতে হয়। ফরমালিন বা অন্য কোনো রাসায়নিক মেশানোর কথা কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার ভয়ে মাথায়ও আনেন না বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা। বৈষম্যের এই নীতি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
বিভিন্ন খাদ্যের মতো ফল থেকেও শরীরে ফরমালিন ঢুকে স্বাস্থ্যের ভয়ানক ক্ষতি করার বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসার পর সচেতন মানুষ বিদেশি ফল খাওয়া কমিয়ে দিয়ে যখন দেশি ফলের দিকে ঝুঁকেছে, তখন জানা যাচ্ছে আরেক দুঃসংবাদ। সেটা হলো- দেশি ফলেও ধরা পড়ছে ফরমালিন। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, মানুষ যাবে কোথায়? খাবে কী?
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১২ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের ফল আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে, যার পেছনে ব্যয় হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। এসব ফল আমদানির ক্ষেত্রে কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড়ের উপস্থিতি যাচাইয়ের জন্য কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে 'কোয়ারেন্টাইন সনদ' দেয়। আর বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন ফলে রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তার উপস্থিতি আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেয় 'রেডিয়েশন সার্টিফিকেট'। এ পর্যন্তই। দুটি পরীক্ষার কোনোটিতেই ফরমালিনের উপস্থিতি ধরা যায় না। তবে মাছ আমদানিতে সম্প্রতি ফরমালিন পরীক্ষা করা শুরু হয়েছে।
বন্দরে আমদানি করা ফলে পোকা ও তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষার পাশাপাশি ফরমালিন পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ বিষয়টি আমাদের সক্রিয় বিবেচনায় থাকবে।' সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অভিযানের ফলে খাদ্যে রাসায়নিকের প্রয়োগ কিছুটা কমেছে বলে দাবি করা হয়। মৎস্য অধিদপ্তর দাবি করেছে, মাছে ফরমালিনের ব্যবহার কমেছে। তবে কোন ফল খেলে নিরাপদ থাকা যাবে, কোন বাজার থেকে কিনলে রাসায়নিকমুক্ত ফল কেনা যাবে- তা নির্দিষ্ট করে দিতে পারেনি সরকারের কোনো সংস্থা। ফলে বাজার থেকে ফল কিনতে মানুষের আস্থাহীনতা রয়েই গেছে। এই আস্থাহীনতার মধ্যে ভরসা ছিল দেশীয় বিভিন্ন ফল। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্টান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট) অভিযান চালালেই বাজারে ফরমালিন পায়। বেশি পাওয়া যায় বিদেশি ফলে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল হোসেন মিঞা বাজার অভিযানের অভিজ্ঞতা থেকে কালের কণ্ঠকে জানান, বিদেশি ফলের মধ্যে মালটা ও আঙুরে বেশি ফরমালিন ধরা পড়েছে। এছাড়া আপেল ও আনারে (ডালিম-বেদানা) কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফরমালিন পাওয়া গেছে। আর দেশি ফলের মধ্যে আমে ফরমালিন মেশানোর প্রবণতা বেশি।
গত ৩ অক্টোবর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বিএসটিআইয়ের দুটি অভিযানে দেশি ফল আমড়া ও জাম্বুরায় ফরমালিন পাওয়া যায়। তাই যেসব ফল এত দিন নিরাপদ মনে করা হতো তাও নিরাপদ রইল না। ওই দিন কাঁচামরিচেও ফরমালিন ব্যবহারের প্রমাণ পান অভিযানকারীরা।
ফরমালিন-ভীতির কারণে ফল আমদানি কমে গেছে উল্লেখ করে ঢাকা মহানগর ফল আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শফি বলেন, 'আমরা বহুবার সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সভায় বন্দরে ফরমালিন পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে বলেছি। পাশাপাশি ঋণপত্রে খাদ্যপণ্যে ফরমালিন পরীক্ষার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার দাবি করেছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। আমরা যদি কোনো চালানে ফরমালিন পাই তা নষ্ট করতে রাজি আছি।'
কোন ফল নিরাপদে খাওয়া যাবে, এমন নিশ্চয়তা যেমন নেই, তেমনি নেই নিরাপদ দোকানের নিশ্চয়তা। ঢাকার সেরা চেইনশপগুলোতেও পাওয়া গেছে রাসায়নিকযুক্ত ফল। ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন ভলান্টারি কনজ্যুমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক খলিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিএসটিআই বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ফরমালিন মেশানো খাদ্যবস্তু থেকে মানুষের আস্থা নষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো উপায় বাতলে দিতে পারেনি, যা থেকে মানুষ নিশ্চিন্তে ফল কিনতে পারে।'
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল হোসেন মিঞার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কোন ফলে ফরমালিন বেশি ব্যবহার করা হয়, তার কোনো বিশ্লেষণ তাদের কাছে আছে কি না। তিনি জানান, এমন কিছু তাঁরা করেননি। তবে এমন বিশ্লেষণ তাঁরা করবেন।
কোনো বন্দরে নেই ফরমালিন পরীক্ষা : চট্টগ্রাম বন্দরে ফল আমদানির ক্ষেত্রে আগে উলি্লখিত দুই ধরনের পরীক্ষার পর পণ্য খালাস করতে হয়। পাশাপাশি যে দেশ থেকে আমদানি হয়, সেই দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট দেখাতে হয়।
কিন্তু এসব পরীক্ষা ফরমালিন বা অন্য কোনো বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো কোনো ফল দেশে আসছে কি না, তা নিশ্চিত করে না। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের দাবি থাকলেও সরকারিভাবে ফরমালিন পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি।
দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলেও ফল-মূল, খাদ্যদ্রব্য, কাঁচামাল পরীক্ষার কোনো গবেষণাগার নেই। বছর দুই আগে বেনাপোল কাস্টম হাউসে গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে তা না করে সেটা এখন কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমনকি ফল ও মাছ পচনশীল পণ্য হওয়ায় এসবের প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন প্রয়োজন হয় না। ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি করা কৃষিজাত পণ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। তবে ওই কেন্দ্রের প্রতি ফরমালিন পরীক্ষার নির্দেশনা নেই। এমনকি পোকামাকড় ও রোগজীবাণু পরীক্ষার কোনো পরীক্ষাগারও নেই।
একজন ফল আমদানিকারক কালের কণ্ঠকে বলেন, আমদানি করা ফলে ফরমালিন পরীক্ষা করতে ঢাকার বিএসটিআইয়ের অফিসে পাঠালে সময় লাগবে এক মাস। তত দিনে সব ফল পচে যাবে। বন্দরে তাৎক্ষণিক ফরমালিন পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে ফরমালিনমুক্ত ফল ব্যবসা সম্ভব নয়।
রপ্তানিতে কঠোরতা : বাংলাদেশ থেকে কিছু রপ্তানি করতে হলে কঠোর মান রক্ষা করতে হয়। লেবু জাতীয় ফল রপ্তানির সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সামনে এক ধরনের রাসায়নিক দিয়ে ওই ফলগুলো ধুতে হয়। পরে তাঁরা ফাইটোস্যানিটারি সনদ দেন, যেটা ইউরোপের দেশগুলো গ্রহণ করে। ওই রাসায়নিকের একটি বোতলের দাম সাড়ে চার হাজার টাকা।
বাংলাদেশ ফল ও সবজি রপ্তানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসুর বলেন, ফলগুলো ধোয়া হয় ফলের গায়ে লেগে থাকা নানা আবরণ (ক্যাঙ্কার) ওঠানোর জন্য। বছরখানেক আগে বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের ফল রপ্তানি হলেই তারা নষ্ট করে ফেলত। পরে তাদের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়। তাদের প্রতিনিধিদল তিন-চারবার বাংলাদেশ সফরের পর ওই রাসায়নিক দিয়ে ধোয়ার পরামর্শ দেয়। তা-ও সাময়িকভাবে। দীর্ঘমেয়াদে তারা কেন্দ্রীয় ওয়্যারহাউস, কুলিং সিস্টেম তৈরি ও চুক্তিভিত্তিক চাষের পরামর্শ দিয়েছে। নইলে তারা আমাদের ফল নেবে না বলে জানিয়েছে।
মোহাম্মদ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ থেকে ফল রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকরা সরাসরি বাগান থেকে ফল কেনেন। তাঁরা কোনো রাসায়নিক ব্যবহারের চিন্তাও করেন না। কারণ রপ্তানির পর কোনো সন্দেহ হলেই ফলগুলো পরীক্ষা করা হবে। একবার রাসায়নিক ধরা পড়লে আজীবনের জন্য রপ্তানি নিষিদ্ধ হবে।
জানা গেছে, ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যে যে ফল রপ্তানি হয় তার ৯৫ শতাংশের ক্রেতা অনাবাসী বাংলাদেশিরা। তাঁরা যে বাজার থেকে কেনেন সেগুলোর পরিচালনা বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ভারতীয় ব্যবসায়ীরাই করেন। সেখানে মানের বিষয়ে একটু শিথিলতা থাকার পরও বাংলাদেশকে রপ্তানির ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয়। আর ইউরোপের ক্রেতাদের জন্য যে বাজার সেখানে বাংলাদেশি এসব ফল ঢুকতেই পারে না।
মৌসুমি ফল খান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ফল খাওয়া প্রয়োজন মিনারেল আর ভিটামিনের জন্য। ভিটামিন সি ও বি কমপ্লেক্স পাওয়া যায় ফলে। তিনি বলেন, 'আমরা মানুষকে যখন ফল খেতে বলি, তখন তাদের প্রথম প্রশ্নই থাকে- কোন ফল খাবেন। এ ক্ষেত্রে আমরা বলে থাকি, যে মৌসুমে যে ফল পাওয়া যায় সেটাই খান।'

No comments

Powered by Blogger.