এনবিআর ও করদাতা by এ এম এম শওকত আলী

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সংক্ষেপে এনবিআর, বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করার দায়িত্ব পালনে লিপ্ত। প্রতিবছর বাজেট প্রণয়নের সময় কর-সংক্রান্ত উৎসের সম্ভাব্য আয় কত হবে তা নির্ধারণ করা হয়।


এ প্রক্রিয়ায় কী কী কর বৃদ্ধি করা হবে বা কোন করের হার হ্রাস করা হবে, তা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। এনবিআর এ বিষয়ে ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করে। সাম্প্রতিককালে এনবিআর আয়কর আদায়ের লক্ষ্যে কর মেলার আয়োজনও করেছে। আয়করের বিষয়ে সব সময় একটা ধারণা ছিল যে করের হার বৃদ্ধি না করে করদাতাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করাই হবে উত্তম কৌশল। কারণ সার্ভে বা জরিপের মাধ্যমে যাঁদের কর দেওয়া উচিত, তাঁদের সহজে শনাক্ত করা যায় না। যদিও এ ধরনের জরিপের মাধ্যমে সার্বিক চিত্র পাওয়া সম্ভব। অতীতে কর ফাঁকির বিষয়টি ছিল বহুল আলোচিত। এ জন্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হতো। এতে যে খুব বেশি সাফল্য অর্জন করা যায়নি, তা সর্বজনস্বীকৃত।
করদাতাদের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই করদাতা শনাক্তকরণ (টিআইএন) প্রথা চালু করা হয়। ফলে জানা যায়, কতসংখ্যক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আয়কর দিচ্ছে। এর সঙ্গে একটি সিদ্ধান্ত হয় যে আইন অনুযায়ী যাঁরা আয়কর দিতে বাধ্য নন, তাঁদেরও আয়-ব্যয়ের বিবরণী দিতে হবে। তবে এ পদক্ষেপ কতটুকু সফল হয়েছে, তা এনবিআরই বলতে পারবে। ধারণা করা যায়, এদের সংখ্যা খুব বেশি হবে না। করযোগ্য আয় নেই অথচ টিআইএনভুক্ত হওয়ার কেন এই বাধ্যবাধকতা। কি জানি কি বিপদে পড়ি- এমন ধারণা অনেকেই পোষণ করেন। এ ছাড়া আয়ের বিবরণী নির্ধারিত ছকে লিপিবদ্ধ করাও একটা ঝামেলা। নাগরিক সমাজসহ বিশেষজ্ঞরাও আয়কর বিবরণী দাখিল করার পদ্ধতি সহজীকরণের পক্ষে প্রায়ই মতামত দিয়েছেন। সহজীকরণ করা সম্ভব হয়েছে কি না তার মূল্যায়নও প্রয়োজন। তবে করদাতাদের জন্য তাঁরা নিজেরাই কর নির্ধারণ করে বিবরণী দাখিল করার সুযোগও পেয়েছেন, যাকে বলা হয় Self assessment system। এ ছাড়া এনবিআর করদাতাদের জন্য কিছু প্রণোদনামূলক পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। কিছু ক্ষেত্রে কর হ্রাস করার ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন মহিলাদের ক্ষেত্রে করযোগ্য আয়সীমা বৃদ্ধি করা হয়। সরকারি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বৃদ্ধি করে এ খাতে সঞ্চয়ীদের আকৃষ্ট করা হয়। এর জন্য উৎসে কর কর্তনের মাধ্যমে এনবিআরের বাড়তি আয়ের সুযোগ হয়। তবে একসময় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হ্রাস করার ফলে অনেকেই বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকেন। কারণ বেসরকারি ব্যাংক ও লিজিং কম্পানিতে অধিকতর হারে আয়ের সুযোগ ছিল এবং এখনো আছে। তবে সাধারণত সঞ্চয়কারীরা সরকারি খাতকেই নিরাপদ মনে করেন। পরবর্তী সময় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বৃদ্ধি করা হয়। সাম্প্রতিককালে সব ধরনের সঞ্চয় হিসাবের বিষয়ে এনবিআর আরো একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ খাতে আগে উৎসে কর কর্তনের হার ছিল ১০ শতাংশ। বর্তমানে টিআইএন-বিহীন সঞ্চয়ীদের জন্য এ হার বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আশা করা যায়, এর ফলে কর আরোপযোগ্য ব্যক্তিরা টিআইএন-ভুক্ত হবেন।
দেশব্যাপী বার্ষিক করমেলা অনুষ্ঠানের বিষয়ে এনবিআর উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছে। ফলে নতুন করদাতারা ওই মেলায় টিআইএনভুক্ত হয়ে কর দিচ্ছেন। এ সত্ত্বেও করদাতাদের ভোগান্তি হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। করমেলার মাধ্যমে করদাতাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কর বিভাগের দপ্তর পুনর্বিন্যাস করার ফলে নিয়মিত বিদ্যমান করদাতাদের আয়কর রিটার্ন দাখিলের দপ্তরও পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন হয়। সূত্র মতে, সিংহভাগ করদাতারা কোন আঞ্চলিক দপ্তরে কর দেওয়া হবে, সে বিষয়ে কিছুই জানে না। এমনই কয়েকজনের তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রকাশিত সংবাদে লিপিবদ্ধ হয়েছে। পক্ষান্তরে এনবিআরের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, আঞ্চলিক দপ্তর পরিবর্তনের বিষয় সব বিদ্যমান করদাতাকে জানানো হয়েছে। বাস্তবে তা হয়নি। এ বিষয়ে নাম উল্লেখ করাসহ একাধিক করদাতার সাক্ষাৎকারের বিষয়াবলি উল্লিখিত দৈনিকে পাওয়া যায়, যা কর বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত ব্যক্তিরাও সমর্থন করেন। সবচেয়ে মজার কথা হলো- ওইসব ব্যক্তিও দপ্তর পুনর্বিন্যাসের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্পর্কে অবহিত নন। কারণ একজন বিদ্যমান করদাতা কয়েক দপ্তরে যাওয়ার পর একটি দপ্তরে কিছু আশার আলো পান। সে দপ্তরটি অবশ্য তাঁর জন্য সঠিক ছিল না। এ সত্ত্বেও তাঁর দুরবস্থা দেখে একজন কর্মকর্তা তাঁকে এ দপ্তরেই রিটার্ন দাখিল করার অনুরোধ করেন। ওই কর্মকর্তা আশ্বাস দেন যে এরপর তিনি নির্ধারিত দপ্তরে রিটার্নটি পাঠাবেন। করদাতা এ বিষয়ে প্রাপ্তির চিঠি দাবি করলে ওই কর্মকর্তা তা দিতে পারেননি। একজন আন্তরিক করদাতার সমস্যার সমাধান হলো না। আরো ভোগান্তির পর হয়তো হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর কর রিটার্নের সময়সীমা এক মাস বৃদ্ধি করেছে। আশা করা যায়, এ সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই দপ্তর পুনর্বিন্যাসের সঠিক তথ্য সব করদাতাই জানতে সক্ষম হবে।
সংশ্লিষ্ট করদাতা একাধিক কর দপ্তরে গিয়েও সঠিক দপ্তর খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিছুদিন আগে এনবিআর ঘোষণা দিয়েছিল যে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তিত হলে ব্যক্তিগতভাবে কর দপ্তরে আসার প্রয়োজন হবে না। উল্লিখিত করদাতার অভিজ্ঞতাই প্রমাণ করে যে এ পদক্ষেপ চালু হলেও সচল হয়নি। যদিও কোনো দিন হয়, তাহলেও কর দপ্তরের বিভিন্ন তথ্যের প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া আইন অনুযায়ী কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত শুনানিরও প্রয়োজন হতে পারে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হবে না।
পক্ষান্তরে করদাতাদের একটি অংশ আয়কর রিটার্ন দাখিল করার বিষয়ে আইনজীবী নিয়োগ করে থাকে। এদের ঝামেলা কম। নিয়োগকৃত আইনজীবী বা তাঁর প্রতিষ্ঠান আয়কর রিটার্ন দাখিলসহ শুনানি ও শেষ পর্যন্ত কর পরিশোধের সনদ বের করে থাকে। আয়কর পরিশোধের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মক্কেল বহুলাংশে ঝামেলামুক্ত। তবে এর জন্য কিছু অর্থ ব্যয় অবশ্যই করতে হয়। এ ব্যয়ের সঙ্গে আইনজীবী বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের ফিসহ কিছু অর্থ অদৃশ্য খাতে ব্যয় করা হয়, যা মোট ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো আইনজীবীদেরই ব্যবহার করে থাকে। এদের ঝামেলা নেই বললেই চলে। কিছু ঝামেলা অবশ্যই থাকে, তবে ব্যক্তিগত করদাতাদের তুলনায় তা ভিন্নতর। কারণ বিভিন্ন নামের ব্যবসায়ী সমিতি কর প্রদানের পদ্ধতিগত জটিলতা দূর করার জন্য প্রায়ই মতামত ব্যক্ত করে। এ ছাড়া প্রতিবছর বাজেট প্রণয়নের আগে এসব সমিতির মতামতও এনবিআর গ্রহণ করে থাকে। এ উদ্যোগ উত্তম। কারণ ব্যবসায়ীরাই জানবে, কী ধরনের করারোপনীতি ব্যবসাবান্ধব। তবে যা ব্যবসাবান্ধব সব সময় তা রাষ্ট্রবান্ধব নাও হতে পারে। উন্নয়নসহ রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন উৎসের কর সর্বাধিক আহরণ করাই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। তবে এ কথাও সত্য যে করের মাত্রা ও আদায় সহনীয় পর্যায়ে না রাখলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এ কারণে সার্বিকভাবে করনীতি ও আদায়ের কৌশল নাগরিকবান্ধব হওয়া প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ব্যর্থতা অধিকতর হলে মাথাপিছু আয়ও কমে যাবে। করের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে না।
এনবিআর দাবি করেছে, আয়কর আদায় আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এ দাবিকে সমর্থন করে। তবে কর আদায়ের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়টি একমাত্র এনবিআরের ওপর নির্ভরশীল নয়। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে যে বিষয়টি দৃশ্যমান তা হলো, প্রায় ৩০ লাখেরও অধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান টিআইএন-ভুক্ত হলেও কর পরিশোধকারীদের সংখ্যা ১৩ কি ১৪ লাখের কম। অর্থাৎ টিআইএনভুক্ত প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এ জন্য যাঁরা টিআইএন-ভুক্ত হয়েছেন অথচ কোনো করই দিচ্ছেন না, তাঁদের এ বিষয়ে সহযোগিতা প্রয়োজন। এলাকাভিত্তিক কর কর্মকর্তাদেরও এ বিষয়ে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। এর জন্য সম্ভাব্য পন্থা একমাত্র কর ফাঁকির মামলা ফলপ্রসূ হবে না। টিআইএনভুক্ত ৩০ লাখের মধ্যে করদাতা যদি এক-তৃতীয়াংশেরও কম হয়, তাহলে এর সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে? অন্যান্য খাতের কিছু আইনে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে টিআইএনের নম্বর উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাঁরা টিআইএনভুক্ত হন এ কারণেই। পরে আয়কর দিল কি না দিল তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ ওইসব বিষয় এনবিআরের এখতিয়ারভুক্ত। এসব ক্ষেত্রে বিগত সর্বশেষ বছরের কর পরিশোধ-সংক্রান্ত কাগজপত্র দাখিল করার বাধ্যবাধকতা থাকলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.