আভিজাত্যের গান ॥ বাণিজ্যের গান by মিলু শামস

বছর দুয়েক আগে মিরর মিডিয়া আয়োজিত ‘গুলাম আলী গজল সন্ধ্যা’য় গিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এবার অভিনব আরেক অভিজ্ঞতা হলো শিল্পকলা একাডেমীতে ক্ল্যাসিক যন্ত্র ও কণ্ঠশিল্পীদের অনুষ্ঠানে গিয়ে।


দেশের শ্রদ্ধেয় এক গুণী ওস্তাদ সরোদ বাজাচ্ছেন। পুরো হল নিস্তব্ধ। বাজানো শেষ হলে তুমুল হাততালি। তাঁর আগে বাজিয়েছেন আরেক জন। ওস্তাদের বাজানো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের প্রধান ভিআইপি অতিথি (একজন মন্ত্রী) হল ছেড়ে যান, সঙ্গে আরও দু’চারজন। অনুষ্ঠান চলতে থাকে। এবার কণ্ঠসঙ্গীতের পালা। যিনি গাইছেন তিনিও দেশের প্রথম সারির ক্ল্যাসিক শিল্পীদের একজন। প্রথম গান শেষ হতেই আবার করতালি। তারপর আবার। শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়ায় কেমন সন্দেহ হয়। কেমন যেন আবেগহীন মনে হয় প্রকাশের ধরন। চোখ সরু করে ভাল করে অডিয়েন্সের দিকে তাকাতে ভেতরে লালিত সন্দেহকেই সত্যি মনে হয়। এরা সম্ভবত ভাড়াটে শ্রোতা। মনে মনে হেসে ফেলি। যিনি আয়োজন করেছেন (নাম বলা যাবে না) তিনি প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার কাছের মানুষ। তার সংস্কৃতিমনস্কতার ঠিকুজি-কুলজির পাঠোদ্ধার করলে এই সিদ্ধান্তের সম্পর্কে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এলিট মহলে নিজেকে কালচারড প্রমাণ করার এও এক পলিটিক্যাল কৌশল!
তবে যে সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে কালচারড প্রমাণ করে আজকের দিনে মানুষের বাহবা পাওয়া যায় তার শুরু কিন্তু ছিল অন্য রকম। সে ইতিহাস প্রদক্ষিণ করলে অনেক মজার তথ্যের সঙ্গে পাওয়া যাবে সঙ্গীত বাণিজ্যের নানা উপকরণও। সময় বদলের সঙ্গে তার রূপ বদলেছে শুধু। অডিওর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভিস্যুয়াল মাধ্যম। আর তাতেই পরিবর্তনটাকে মনে হয় একলাফে এগিয়েছে প্রায় আলোকবর্ষ সমান দূরত্ব।
উনিশ শতকের শেষ তিন দশক পর্যন্ত গান ছিল বারবনিতাদের ব্যাপার স্যাপার। ‘আমোদ ফুর্তি’ করতে পুরুষরা বাঈজীদের কাছে গিয়ে গান বাজনার আসর জমাতেন। ‘ভদ্র’ বাড়ির অন্তপুরে গানের জায়গা ছিল না। কারণ গান গেয়ে যারা পয়সা আয় করতেন সেই বাঈজীরা সমাজে ঘৃণিত ছিলেন। ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত ‘সঙ্গীত’ নিবন্ধে বঙ্কিম চন্দ্র বলেছেন, “কুলকামিনীরা সঙ্গীতা নিপুণা হইলে গৃহমধ্যে এক অত্যন্ত বিমলানন্দের আকর স্থাপিত হয়। বাবুদের মদ্যাসক্তি এবং অন্য একটি গুরুতর দোষ অনেক অপনীত হইতে পারে। এতদ্দেশ্যে নির্মল আনন্দের অভাবেই অনেকের মদ্যাসক্তির কারণ সঙ্গীতপ্রিয়তা হইতেই অনেকের বারস্ত্রীবশ্যতা জন্মে।” বিশ শতকের গোড়ার দিকে এই বাঈজীদের গানই গ্রামোফোন বা কলের গানের মাধ্যমে অভিজাতদের অন্দর মহলে ঢুকে যায়। যারা কণ্ঠ বিক্রি করে পুরুষদের ‘আমোদ’ দিতেন তাঁদেরই কণ্ঠ গ্রামোফোনে ধারণ করে ভিন্ন আঙ্গিকে বিপণনের ব্যবস্থা হয়। শ্রোতাদের বিভিন্ন টার্গেট গ্রুপের জন্য তৈরি হতে লাগল ভিন্ন স্বাদের গান।
গ্রামোফোন কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শুরুতে প্রায় সব কোম্পানি শহর উপশহর থেকে খুঁজে সম্ভাবনাময় শিল্পীদের গান রেকর্ড করার উদ্যোগ নিয়েছিল। আরও পরে প্রায় প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব ‘নির্বাচক বোর্ড’ ছিল। যেখানে থাকতেন দক্ষ গীতিকার, সুরকারসহ সঙ্গীত বিশেষজ্ঞরা। যাঁরা প্রতিভাময় কণ্ঠ খুঁজে বের করতেন। কণ্ঠ আর কণ্ঠের গায়কী অনুযায়ী গান লিখতেন, সুর করতেন, দীর্ঘদিন অনুশীলন করাতেন। যখন তাঁরা শিল্পীদের গানে সন্তুষ্ট হতেন কেবল তখনই ওই শিল্পীদের গান রেকর্ড করার অনুমোদন দিতেন। এ কাজের জন্য কোম্পানি তাদের বেতন দিত। এর পর এলো বাঁধা শিল্পীর প্রচলন। প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব গায়ক-গায়িকা থাকত। এক কোম্পানির গায়ক-গায়িকা অন্য কোম্পানির ডিস্কে কণ্ঠ দিতে পারতেন না। ওই গায়ক-গায়িকাদের দিয়েই নতুন গান ছাড়া হতো। পুরনো দিনের গানের এক প্রবীণ শিল্পী আক্ষেপ করে বলছিলেন, “আগেকার দিনে গ্রামোফোন কোম্পানির মতো সংস্থা আক্ষরিক অর্থেই ছিল ট্যালেন্ট হান্টার্স। তারা যে শুধু প্রতিভা খুঁজে বের করত তাই নয় রীতিমতো কষ্টি পাথরে, সেই সোনা আসল কিনা তা যাচিয়ে নিতেন। আজকাল তো টাকা থাকলেই ক্যাসেট করে রাতারাতি শিল্পী হয়ে যাওয়া যায়। আর প্রতিভা পরখ করে নেয়ার মতো যোগ্য বিচারকই বা কোথায়? এই সব ক্যাসেট কোম্পানির কর্ণধাররা গানের উৎকর্ষ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না। গানের ব্যাপারে বোঝেনও না বিশেষ কিছু। বাণিজ্যিক দিকটাই এঁদের কাছে প্রধান। গ্রামোফোন বা রেকর্ড প্লেয়ারের বৃহদাকারের সরঞ্জামের বদলে এখন ওয়াকম্যান কানে গানকে যত্রতত্র নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। টেপ রেকর্ডার, সিডি প্লেয়ার এমন বহুবিধ যন্ত্রের সাহায্যে, গান শোনার পথটা আরও সহজ হয়ে গিয়েছে। তবু কেন সে গান শ্রোতাদের প্রাণের গান হয়ে উঠতে পারছে না? আসলে এখনকার শিল্পীরা গানের কথা ও সুরের দিকে নজর দিতে ভুলে গেছেন। আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে রেকর্ডিং হওয়ার ফলে রেকর্ডিংয়ের মান যতই উন্নত হোক না কেন, অর্কেস্ট্রেশনের বাহুল্যে সঙ্গীত থেকে নরম মেলডি বা মাধুর্য ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।”
গ্রামোফোন আমলে প্রতিটি গানের পেছনে রিসার্চ ছিল, শ্রম, মেধা ও সাধনার সমন্বয় ছিল। এখন দুরন্ত গতির যুগ। সঙ্গীতের প্রতিটি কম্পোনেন্টকে আলাদাভাবে পেশা হিসেবে নেয়ার বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। এখন গীতিকার সুরকার শিল্পীর সমন্বয় প্রায় নেই। শিল্পী ট্র্যাক মিউজিকের সঙ্গে গানটি গেয়ে দেন বাকি কাজ মিউজিক এ্যারেঞ্জারের। কম্পিউটারাইজড হওয়াতে এখন কাজগুলো আরও সহজ হয়েছে। তবে নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট ছাপিয়ে পুরনো দিনের গানের রিমেক বা রিমিক্স সম্ভবত বিক্রি তালিকা এবং জানপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে। গত শতকের নব্বই দশকের শেষের দিকে রিমেক রিমিক্স শব্দগুলো পরিচিত হয়ে ওঠে। পুরনো জনপ্রিয় গানগুলো নতুন শিল্পীরা নতুন করে গাইছেন। কখনও হুবহু কখনও সামান্য অদল বদল করে।
প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গীতের ধারাও দ্রুত বদলেছে। এক সময় গান ছিল শুধুই শোনার। গ্রামোফোন প্রসারের আগে রেডিওতে গান শুনত সাধারণ মানুষ। গ্রামোফোনের প্রসারে ধীরে ধীরে রেডিওর কদর কমতে থাকে। টেলিভিশন আসার পর রেডিও প্রায় মৃত। গান এখন শুধু শোনার মধ্যে সীমিত নেই। শোনার চেয়ে বরং দেখাই বেশি। এজন্য অভিযোগের আঙ্গুল তুলে লাভ নেই। সময় বদলেছে। বদলাচ্ছে মানুষ। মানুষের সৃষ্টির ধরন বদলাবে সেটাই স্বাভাবিক। বেশ ক’ বছর আগে একটি ভারতীয় পত্রিকার পুজো সংখ্যায় সে সময়ে ‘জীবনমুখী’ গানে ঝড় তোলা শিল্পী শিলাজিৎ লিখেছে। বছর পাঁচেকের মধ্যে হঠাৎ ম্যাজিকের মতো বদলে গেছে মানুষের চোখ। সত্তরটা টিভি চ্যানেল। মানুষ গোগ্রাসে চোখেই গিলে খাচ্ছে গোটা বিশ্বকে। চোখের খিদে সাংঘাতিক। মিটতেই চায় না। প্রাণও চায়। চক্ষুও চায়। সাংঘাতিকভাবেই চায়। চব্বিশ ঘণ্টার কেবলের দৌলতে মধ্যরাতে কোটি কোটি চোখ পর্যবেক্ষণ করে কাজল, উর্মিলা, জেনিফার লোপেজ, মারিয়া ক্যারের কোমল কটি। তখন আমরা খবর শুনতাম, এখন দেখি। কিছুদিন আগেও মোহনবাগান-টালিগঞ্জ অগ্রগামীর খেলা শুনতাম রেডিওতে। এখন ইউরো কাপে ইংল্যান্ড-ইতালির খেলা টাটকা দেখি। টেলিভিশন বদলে দিয়েছে আমাদের অভ্যাস। আসলে সময়টাই তো বদলে গেছে। আপাতত টেলিভিশনই এখন সংস্কৃতি প্রচারের মাধ্যম। সুতরাং গান কেবল মাত্র সুর, কথা এবং যন্ত্রানুষঙ্গতেই থেমে নেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে ছবিও। আগে ছিল ছবির জন্য গান। এখন গানের প্রয়োজন ছবির। প্রয়োজন মিউজিক ভিডিও। ছবির সঙ্গে ছবি জুড়ে গান দেখানোর বন্দোবস্ত। গান হিট করাতে হলে শ্রোতাদের কানে গান পৌঁছানোটা হলো প্রাথমিক শর্ত। আর সেটা ঘন ঘন করতে গেলে টিভি ছাড়া গতি কই? সুতরাং প্রয়োজন মিউজিক ভিডিও। শুধু মিউজিক ভিডিও দেখালেই হবে না। এমনভাবে দেখাতে হবে বা এমনভাবে ছবি করতে হবে যা চলার সময় দর্শক অন্য কোনো চ্যানেলে চলে না যান।
মারিয়া ক্যারের ‘হার্ট ব্রেকস’ পাঁচ মিনিটের ছবি তৈরি করার জন্য তোলা হয়েছিল পাঁচ ঘণ্টার ফুটেজ। যাতে প্রতিটি ফ্রেম হয় দারুণ আকর্ষণীয়। ‘ইউফোরিয়া’ গ্রুপের ‘মায়েরি’ গানটার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল একটা আস্ত ট্রেন। এখন এ সবই হচ্ছে। লাখ লাখ টাকা খরচা হচ্ছে একটা গান দেখানোর জন্য। সত্তর-আশিটা চ্যানেল। হাজার হাজার গান। সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা। আর এই কথা মাথায় রেখে শুরু হয়ে গেছে দেখানোর লড়াই। কে কতটা দেখাবে। কিভাবে দেখাবে।
এই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা। গান এখন শুধুই নির্মল আনন্দ বা বিশুদ্ধ চর্চার বিষয় নয়। পুরোপুরি বাণিজ্যিক উপকরণ। একটা গানের পেছনে যে বিপুল টাকা লগ্নী করা হয় সে টাকা তুলে আনতে সব ধরনের কৌশল নেয়া হবে তাই স্বাভাবিক। শিলাজিৎ যখন উপরের কথাগুলো বলেছিলেন তখনও ইন্টারনেটের এমন জয়জয়কার হয়নি। গান নিয়ে মোবাইল কোম্পানির বাণিজ্যও সেভাবে শুরু হয়নি। এখন শোনার ইচ্ছে হোক না হোক শুনতে যেন আমরা অনেকটা বাধ্য। এইচ, এমভি যখন একচেটিয়া আধিপত্য করে গেছে তখন নতুন গান শোনার জন্য প্রায় সারা বছর অপেক্ষা করতে হতো। এখন প্রায় প্রতিদিনই এক। কিংবা একাধিক করে নতুন সিডির জন্ম হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.