নাফিসকে সব সহায়তা দেবে ঢাকা ॥ সাক্ষাত চেয়েছেন রাষ্ট্রদূত- ০ মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দূতাবাসের বৈঠক- ০ প্রশ্নবিদ্ধ স্টিং অপারেশন- ০ মার্কিন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাকে আইনী সহায়তা দিচ্ছে by মাহফুজুর রহমান

নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার নাটকীয় পরিকল্পনার অভিযোগে এফবিআই ও নিউইয়র্ক পুলিশের হাতে গ্রেফতার বাংলাদেশী শিক্ষার্থী কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চেয়েছে ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস।


১৮ অক্টোবর শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের বিচার মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত একরামুল কাদের জানিয়েছেন, ‘আমরা বাংলাদেশী নাগরিক নাফিসের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েছি। আর তখন সে যদি আমাদের কাছে আইনগত সহায়তা কামনা করে তাহলে আমরা তা দেব।’
নাফিসের বাংলাদেশী জাতীয়তা নিশ্চিত করে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘নাফিসের পাসপোর্টের কপি আমাদের দেয়া হয়েছে। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, সে বাংলাদেশেরই নাগরিক। তাই তার নাগরিক অধিকারের মধ্যে যতটা প্রাপ্য ততটা সহায়তা দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। আমরা সে বিষয়টি আইন ও বিচার বিভাগের উপ-সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল ব্রুস সোয়ার্টজকে জানিয়েছি।’
ওয়াশিংটনে বিচার বিভাগের শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় বৈঠকে যোগ দেন রাষ্ট্রদূত একরামুল কাদের। তিনি বলেন, ‘বিচারে যদি প্রমাণিত হয়, নাফিস সত্যিকার অর্থেই যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা করতে চেয়েছিলেন, তাহলে তার যে শাস্তি হবে আমরা তা মেনে নেব।’
বিচার বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রদূত অনুরোধ করেন, ব্যক্তি নাফিসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী বাংলাদেশীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব যেন না দেখানো হয়।
তিনি জানান, বিচার বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন যে, নাফিজের কারণে বাংলাদেশী-আমেরিকানদের বিরূপ দৃষ্টিতে দেখার কোন কারণ নেই।
এদিকে নাফিসকে ইতোমধ্যেই আইনী সহায়তা দিচ্ছে ফেডারেল ডিফেন্ডারস অব নিউইয়র্ক নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী আইনী সংস্থা। এই সংস্থার আইনজীবী মিসেস হেইদি ক্লারা সিজারে নাফিসের পক্ষে প্রথম দিনেই আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সাল থেকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফেডারেল মামলায় অভিযুক্ত দরিদ্র ও অসহায়দের আইনী সহায়তা দিয়ে আসছে। নিউইয়র্ক ইস্টার্ন ফেডারেল কোর্ট যা ব্রুকলীন ফেডারেল কোর্ট নামে পরিচিত সেই চ্যাপ্টারের অফিস থেকে নাফিসকে আইনী সহায়তা দিচ্ছে ফেডারেল ডিফেন্ডারস অব নিউইয়র্ক।
নিউইয়র্কে প্রবাসীদের সমাবেশ
বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র শাখার উদ্যোগে নিউইয়র্কে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, নাফিস যদি সত্যিকার অর্থে দোষ করে থাকেন তাহলে তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি দেযা হোক। তারা বলেছেন, নাফিস যদি অপকর্ম করে থাকে তাহলে সে জন্য গোটা বাংলাদেশীদের ওপর যেন দায় চাপানো না হয়। বক্তারা উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ এবং বাঙালীরা কখনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদকে সাপোর্ট করে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারও সন্ত্রাসের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি পালন করে আসছেন। বাংলাদেশ সময় শনিবার সকালে নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে পালকি পার্টি সেন্টারে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠনের আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট মোর্শেদা জামান এবং পরিচালনা করেন সদস্য সচিব এ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান মামুন।
এদিকে বাংলানিউজ জানায়, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই নাফিসকে যে কৌশল প্রয়োগ করে গেফতার করেছে তার নাম স্টিং অপারেশন। এটি মূলত একটি কৌশল, যার মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে, অপরাধ করতে সহযোগিতা দিয়ে অপকর্মের ঠিক আগ মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধরে ফেলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের অভিযান প্রচলিত থাকলেও এর নৈতিক ও আইনী দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ধরনের অভিযানের সমালোচনা হচ্ছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই। সুইডেন, নেদারল্যান্ডসের মতো কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্টিং অপারেশন নিষিদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের সুশীল সমাজের অনেক সংগঠনই স্টিং অপারেশনের সমালোচনা করে আসছে। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়নসহ সুশীল সমাজের কয়েকটি সংগঠনের আবেদন গত আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত খারিজ করে দেন। তবে আদালতের বিচারক করম্যাক কার্নি তাঁর ৩৬ পৃষ্ঠার রায়ের একটি অংশে বলেছেন, তিনি জাতীয় নিরাপত্তাকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উর্ধে স্থান দিতে বাধ্য হয়েছেন।
ফ্রান্স টোয়েন্টিফোরডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন অনেক মামলা আছে, যেখানে বিচারকরা স্বীকার করেছেন, এফবিআই’র কৌশল প্রশ্নবিদ্ধ। সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত এফবিআই’র বহুল আলোচিত স্টিং অপারেশনগুলোর অন্যতম ছিল দআবদুল স্ক্যামদ বা সংক্ষেপে দআবস্ক্যামদ। চুরি হওয়া জিনিসপত্র উদ্ধারে এ অপারেশন শুরু হলে তা শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে পরিণত হয়েছিল। ওই তদন্ত অভিযানের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনেটর, প্রতিনিধি পরিষদের (হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ) পাঁচ সদস্য, নিউ জার্সি স্টেট সিনেটের এক সদস্য, ফিলাডেলফিয়া সিটি কাউন্সিলের কয়েকজন সদস্য এবং অভিবাসন বিভাগের একজন পরিদর্শক দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
ওই অভিযানের শুরুতে ১৯৭৮ সালে এফবিআই’র কর্মীরা আবদুল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলে। এফবিআই কর্মীদেরই একজন করিম আবদুল রহমান নামে আরব শেখ সেজে সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও টেপের মাধ্যমে যোগাযোগ এবং অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের ওই ফাঁদে পা দিয়ে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন অনেকেই।
গত বুধবার নাফিস গ্রেফতার হওয়ার পর নিউইয়র্ক পুলিশ বলেছে, তিনি আসলে এফবিআই’র পাতা ফাঁদে পা দেন। এফবিআই’র কৌঁসুলিরাও বলেছেন, নাফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এমনই একজন পরে এফবিআই’র সোর্সের ভূমিকা নিয়ে তথ্য সরবরাহ করেন।
এ ধরনের স্টিং অপারেশনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান কি- গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তবে কূটনৈতিক ও অন্যান্য সূত্র জানিয়েছে, স্টিং অপারেশন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও এটি অপরাধী ধরার কার্যকর কৌশল হিসেবেও বিবেচিত হয়। এর মাধ্যমে মূলত অপরাধীর সঙ্গে প্রতারণা করা হয়।
জানা যায়, সাধারণত স্টিং অপারেশনে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা বা তাঁদের সোর্সরা অপরাধী বা সম্ভাব্য অপরাধীর সহযোগী ভূমিকা গ্রহণ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন। এর মাধ্যমে মূলত সম্ভাব্য অপরাধীর বিরুদ্ধে ফাঁদ পেতে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশী তরুণ নাফিসের ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছে।
স্টিং অপারেশনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা কখনও মাদক বা অস্ত্রের ক্রেতা সেজে মাদক ও অস্ত্র বিক্রেতাকে ফাঁদে ফেলেন। নৈতিকতা ইস্যুতে আলোচনা-সমালোচনা যা-ই থাকুক না কেন, অনেক দেশেই এটি বৈধ প্রক্রিয়া। তবে অপরাধ সংঘটনে কাউকে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ে আইনী প্রক্রিয়া দেশে দেশে ভিন্ন।
স্টিং শব্দটি মূলত জনপ্রিয়তা পেয়েছে ১৯৭৩ সালের রবার্ট রেডফোর্ড ও পল নিউম্যানের দ্য স্টিং সিনেমা থেকে। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী তিনটি সংস্থা যৌথভাবে স্টিং অপারেশন চালিয়ে চুরি হওয়া চাঁদের প্রস্তর খণ্ড মিয়ামির একটি ভল্ট থেকে উদ্ধার করে। ওই স্টিং অপারেশনটির নাম ছিল অপারেশন লুনার একলিপস।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর প্রবলেম ওরিয়েন্টেড পুলিশিং (সিপিওপি) থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত স্টিং অপারেশন সম্পর্কিত গাইডে বলা হয়েছে, এ ধরনের অপারেশনের কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে না। দোষী সাব্যস্ত করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়ার আগ পর্যন্ত এ অভিযান চলতে থাকে। আর এ ধরনের তদন্ত অভিযানে গ্রেফতার ও দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যাও অনেক। সিপিওপির তথ্য মতে, একটি স্টিং অপারেশনে ৭০০ জনকে পর্যন্ত গ্রেফতার করার নজির আছে।

সব ধরনের আইনী সহায়তা দেয়ার আশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের
যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসকে (২১) পূর্ণ বিচারিক সুবিধা দেয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে অভিযোগ ওঠা কোন ব্যক্তিকে সব ধরনের মানবিক ও আইনী সহযোগিতা দেয়ার বিষয় নিশ্চিত করা হবে।
গ্রেফতার হওয়া নাফিসের বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের বৈঠক হয় শুক্রবার রাতে। ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের, ডেপুটি চীফ অব মিশন এমএ মুহিত এবং যুক্তরাষ্ট্রের আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের উপসহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল ব্রুস সোয়ার্টজ অংশগ্রহণ করেন। এ সময় বলা হয়েছে, মার্কিন বিচার বিভাগ মনে করে নাফিসের গ্রেফতার ঘটনা এখনও তদন্ত পর্যায়ে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দেয়া পূর্ণ নাগরিক, মানবিক ও আইনী সুবিধা নাফিসের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে।

No comments

Powered by Blogger.