রামেক হাসপাতালের বেহাল দশা, নিত্যসঙ্গী দুর্ভোগ by শরীফ সুমন

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে এক্স-রে করাতে দিনে গড়ে ৭০ জনেরও বেশি রোগী উপস্থিত হন। কিন্তু তাদের বেশিরভাগকেই হাসপাতাল থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তাই হাসপাতালে এক্স-রে করার ব্যবস্থা থাকলেও এক রকম বাধ্য হয়েই বাইরে থেকে রোগীদের বেশি টাকায় এক্স-রে করাতে হচ্ছে। এর মধ্যে আবার হরহামেশাই বিকল হয়ে থাকে হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন দুটি। আর অতি প্রয়োজনীয় সিটি স্ক্যান মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে ৯ মাস ধরে।
শুধু এক এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান মেশিনই নয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চরম অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির কারণে রোগীদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে প্রতিদিনই। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা ডা. মহিবুল হাসানকে বদলি করার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমলেও দূর হয়নি অব্যবস্থাপনা।

গত এক বছরে এই হাসপাতালে কর্মরত ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্সরা ৫ বার ধর্মঘট করেছেন। চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ জোরেশোরে উঠেছে হরহামেশাই। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে নার্স সংকট প্রকট থাকলেও এর সমাধান হয়নি আজও। 

নার্স সংকট
রামেক হাসপাতালে নার্স সংকট এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে রোগীদের সেবা ব্যাহত হচ্ছে প্রতিনিয়তই। এমনকি গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের শিক্ষানবিশ নার্সরা রাতের বেলা পর্যাপ্ত সিনিয়র নার্স ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার প্রতিবাদে ধর্মঘট করেছিলেন।

এর ফলে রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে প্রতিদিন। রোগীদের স্বজনরা এ নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়ছেন নার্সদের ওপরই।

রামেক হাসপাতালের নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট মুনিরা খাতুন জানান, হাসপাতালের ৩২টি ওয়ার্ডে স্টাফ নার্স ৩০৬ জন। এদের মধ্যে ৭ জন প্রেষণে অন্যত্র রয়েছেন।

তিনি জানান, সহকারী নার্স রয়েছেন ১৬ জন। নার্সিং সুপার রয়েছেন ২৩ জন। খাতা-কলমের হিসাবে ৫৩০ শয্যার এই হাসপাতালে নার্স সংকট খুব বেশি নেই বলে মনে হতে পারে। তবে প্রকৃতপক্ষে এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার রোগী ভর্তি হন। সেই হিসেবে নার্স সংকট তীব্র।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, সরকারি হিসেবে প্রতি ৫ জন রোগীর বিপরীতে একজন নার্স থাকার কথা। কিন্তু হাসপাতালে তারা একেকটি ওয়ার্ড চালান দুইজন নার্স দিয়ে। আর একেকটি ওয়ার্ডে প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৫০ জন রোগী বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি থাকেন।

কথায় কথায় ধর্মঘট
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সবচেয়ে বড় সংকটটি হচ্ছে এখানে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কথায় কথায় ধর্মঘট ডেকে বসেন। এর স্থায়ী সমাধান করার কোনো পথও খুঁজে পায়নি কর্তৃপক্ষ। প্রতি বছর ধর্মঘটের পর বৈঠকের পর বৈঠক করা হয়। এরপর সাময়িকভাবে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে না। কিছুদিন পরেই অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে ধর্মঘট ডেকে দেওয়া হয়।

গত এক বছরে হাসপাতালে এ ধরনের ৫টি ধর্মঘটের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ঘটনা ঘটে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। এদিন আসাদুজ্জামান নামের এক রোগীর মৃত্যুর পর তার স্বজনরা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলেন।

এ নিয়ে উত্তেজিত অভিভাবকরা ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ওপর চড়াও হন। এর পরই ধর্মঘটের ডাক দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। বারবার এ ধর্মঘট ডাকার ঘটনায় রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয় ভীষণভাবে। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে চিকিৎসা অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগও উঠছে প্রতিনিয়ত।

গত ৬ মার্চ সর্বশেষ অভিযোগ ওঠে রুমা বেগম নামে একজনের মৃত্যুর পর। স্বজনদের দাবি, ওয়ার্ড বদল ও কী চিকিৎসা দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করতে কালক্ষেপণ করায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

ইন্টার্ন চিকিৎসকরা দাবি করেছেন, রোগীর অভিভাবকরা প্রায়ই তাদের ওপর চড়াও হন। এমনকি তারা হাসপাতালে ভাঙচুর পর্যন্ত চালান। এসব ঘটনায় নিরাপত্তার দাবিতেই তারা ধর্মঘটে যান।

বিএমএ রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. খলিল অবশ্য মনে করেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে যায়। তিনি দাবি করেন, কোনো চিকিৎসকই চান না রোগীর মৃত্যু হোক। তিনি বলেন, ৫৩০ শয্যার এ হাসপাতালে রোজ ১৩শ’ রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়।  এখানে সংকট তো থাকবেই।

এরপরেও হাসপাতালের পরিচালক এবং পরিচালনা কমিটির সভাপতি সিটি মেয়র লিটন রোগীদের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন বলে জানান তিনি। 

নতুন উপদ্রব বর্জ্যের ধোঁয়া
হাসপাতালকে বর্জ্যমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখার জন্য প্রায় ১০ বছর আগে হাসপাতাল চত্বরেই বর্জ্য পোড়ানোর প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়। গত বছর এই প্ল্যান্টটির চিমনি ভেঙে যায়। ফলে হাসপাতালের বর্জ্য এখন প্লান্টের ভেতরে না পুড়িয়ে বাইরেই পোড়ানো হচ্ছে। এসব বর্জ্যের ধোঁয়া এখন প্রতিটি ওয়ার্ডে ঢুকছে। অস্বাস্থ্যকর এই ধোঁয়া রোগীদের জন্য নতুন উপদ্রব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ ব্যাপারে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান ও ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুজ্জামান কামরু জানান, এই প্ল্যান্টটিকে খুব দ্রুত সিটি হাটের কাছে নতুন ভাগাড়ে সরিয়ে নেওয়া হবে। এর কাজ চলছে বলে দাবি করেন তিনি।

তবে রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. বরকত উল্লাহ দাবি করেন, ছোটখাটো সমস্যা থাকলেও রামেক হাসপাতালে রোগী দুর্ভোগ এখন কমে এসেছে। এখানে কোনো অব্যবস্থাপনা নেই।

আর হাসপাতালের পরীক্ষা নিরীক্ষার মেশিনগুলো সচল রাখার জন্য তারা সবসয়মই সচেতন বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.