খালেদা জিয়ার ব্যক্তি স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে জনগণ সাড়া দেবে না by মাহবুবউল আলম হানিফ

সমকাল : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের যৌক্তিকতা কতটুকু? সরকারের আড়াই বছরের মাথায় এ বিতর্ক সৃষ্টির কি প্রয়োজন ছিল? হানিফ :বিএনপি ১৯৯৪ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে মাগুরার উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নজিরবিহীন কারচুপি করার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা আসে।


এ নিয়ে আন্দোলন করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এরই ধারাবাহিকতায় সব রাজনৈতিক দল তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইতিমধ্যে তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী বলেই বর্তমান সরকারের আমলে সবক'টি উপনির্বাচন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশন স্বাধীন হলে অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাটা বিতর্ক নয়। আদালত এ ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করেছে। তাই এ ব্যবস্থা আপনা থেকেই বাতিল হয়ে যাবে। এখনই দরকার ছিল কি-না তা গৌণ। সংবিধান সংশোধনের জন্য এটি স্বাভাবিকভাবেই হচ্ছে।
সমকাল : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলে কোনো সংকট দেখা দেবে কি-না? দেশ কি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে এগোচ্ছে? আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে কি?
হানিফ :তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলে রাজনৈতিক সংকট হবে না। এ পদ্ধতি দীর্ঘদিন চালু থাকলে গণতন্ত্র বিঘি্নত হবে। বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন আমলে নিরপেক্ষতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ওয়ান-ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে নানামুখী নির্যাতন হয়েছে। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিতর্কিত হয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণে আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে বলা হয়েছে। আদালতের রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার কোনো সুযোগ নেই। তবে এ ব্যবস্থার কোনো বিকল্প চিন্তা থাকলে তা নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সব কিছুরই সমাধান সম্ভব। তাই এ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই। আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টিরও আশঙ্কা নেই। তবে এ জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
সমকাল : বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারের কয়েকটি শরিক দল আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে। এটি কি মহাজোটের মধ্যে মতদ্বৈধতা নয়?
হানিফ :এ নিয়ে শরিক দলে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ কখনোই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেনি। আদালতের রায় কার্যকরের প্রয়োজনেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
সমকাল : বিরোধী দলের অভিযোগ, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় আসতে আপনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে কি বলবেন?
উত্তর : আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। এমন নজির বিএনপির নেই। বন্দুকের নলের জোরে এ দলটির জন্ম হয়েছিল। এরাই সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করেছিল। আওয়ামী লীগ এমনটি করেনি। সুতরাং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় আসার ইচ্ছা থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার বিষয়টি আওয়ামী লীগের বেলায় প্রযোজ্য নয়।
সমকাল : বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
হানিফ :প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে কোনো অপব্যাখ্যা দেননি। সম্ভবত বিরোধীদলীয় নেতা আদালতের রায় সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি অথবা তিনি আদালতের রায়ের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।
সমকাল : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন কোনো ফর্মুলা থাকলে তা পেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা এ প্রস্তাব নাকচ করে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মৌলিক কাঠামো বহাল রাখলেই তিনি আলোচনায় রাজি। এ আলোচনা প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয় নিয়ে হতে পারে বলে তার মন্তব্য। আপনাদের মত কী?
হানিফ :বিষয়টি ঘোড়ার আগে চাবুক কেনার মতো। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান সংবিধানে রাখার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে কে প্রধান উপদেষ্টা হবেন তা নিয়ে আলোচনার বিষয়টি কি ঘোড়ার আগে চাবুক কেনার মতো নয়?
সমকাল : বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে আলোচনায় রাজি বলে জানিয়েছেন। এ প্রস্তাবে আপনাদের বক্তব্য কী?
হানিফ :বর্তমানে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন নিরপেক্ষ রয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালে এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করেছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি এমএ আজিজের মতো বিতর্কিত ও দলীয় ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করেছিলেন। আসলে খালেদা জিয়া নিরপেক্ষ বলতে তার নিজের দলের লোককেই বোঝেন।
সমকাল : আপনারা এবং ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বদলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী করে এর অধীনে আগামী নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও বিরোধী দলসহ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদৌ সম্ভব কি?
হানিফ :অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও বিরোধী দলসহ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। এক সময় বাংলাদেশেও এ ব্যবস্থা ছিল। এখন সারা দুনিয়ায় এভাবেই নির্বাচন হচ্ছে। তবে কি দুনিয়ার কোথাও নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না? ব্যাপারটা তা নয়। পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রেও নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে না। ভারতসহ বহু দেশে এ ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। তাহলে বাংলাদেশে কেন হবে না?
সমকাল : বর্তমান সময়ের আলোচিত বিষয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সিস্টেম। এটি নিয়ে বিরোধী দলের ঘোরতর আপত্তি আছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
হানিফ :জাতিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য সবক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে ইভিএম সিস্টেম চালু আছে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও কারচুপিবিহীন নির্বাচন সম্ভব। এতে দ্রুত ফল পাওয়া যায়। দেশের জন্যও লাভজনক।
সমকাল : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার কথা বলছেন। আপনার অভিমত কী?
হানিফ :আওয়ামী লীগও আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে রাজপথে সমস্যার সমাধান হবে না। আলোচনা করতেই হবে। এ জন্য সংসদে আসতে হবে।
সমকাল : বিরোধীদলীয় নেতা সংসদ কিংবা সংসদের বাইরে আলোচনার কথা বলছেন। যদি সমঝোতা হয় সেক্ষেত্রে আলোচনা কোথায় হতে পারে? সংসদের বাইরে আলোচনার সুযোগ আছে কি?
হানিফ :আলোচনার জন্য সংসদই উত্তম জায়গা। অতীতে সংসদের বাইরে কোনো বৈঠকই ফলপ্রসূ হয়নি। তবে খালেদা জিয়া চাইলে সংসদের বাইরেও আলোচনা হতে পারে।
সমকাল : বিরোধী দল আলোচনায় না এলে সরকার ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা কী হবে?
হানিফ :জাতির সামনে আমাদের অবস্থান তুলে ধরব। জনমত গড়ে তুলব। তবে জনগণের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে বিরোধী দল অবশ্যই আলোচনায় আসবে।
সমকাল : বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কঠোর আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে। আপনার মূল্যায়ন কী?
হানিফ :যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিরোধীদলীয় নেতার দুই ছেলে তারেক ও কোকোসহ দুর্নীতিবাজদের বিচার, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, জঙ্গিবাদের বিচার এবং একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। এসবের বিচার হলে সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও জঙ্গিবাদের মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত হবে বিএনপি। এ জন্য বিএনপি সবকিছু বানচাল করতে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে। জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু জনগণ খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে সাড়া দেবে না।
সমকাল : বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় আপনাদের অবস্থান কী হবে?
হানিফ :আওয়ামী লীগ জনগণের দল। সাংগঠনিকভাবেও আওয়ামী লীগ শক্তিশালী। সুতরাং আওয়ামী লীগ এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম হবে। অতীত এবং বর্তমানের মতো ভবিষ্যতেও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেবে।
সমকাল : সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বহাল রাখার কথা বলা হচ্ছে। এটা কি পরস্পরবিরোধী, বাহাত্তরের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং আপনাদের অসাম্প্রদায়িক আদর্শের পরিপন্থী নয়?
হানিফ :দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। আমরা তাদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করতে চাই না। তাদের সেন্টিমেন্টের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সংবিধানে ইসলাম ও বিসমিল্লাহ থাকবে। এর পাশাপাশি অন্য ধর্মেরও সমান অধিকার থাকবে। সুতরাং বিষয়টি বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
সমকাল : সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
হানিফ :নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করে বঙ্গবল্পুব্দর স্বপ্নের আধুনিক দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়াই আমাদের চ্যালেঞ্জ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এনে সব মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করাই আমাদের নিরন্তর প্রচেষ্টা। এ লক্ষ্য সামনে নিয়ে কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিশ্চয়ই তিনি সফল হবেন।
 

No comments

Powered by Blogger.