স্বাধীনতা উদ্যানে লালন by নেহাল আদেল

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি যেন সবাই ভুলে যেতে চলছেন_যাদের বয়স ৪০-এর নিচে, তারাই এ দেশে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৪০ বছর আগে। তবু সেই গণহত্যার তাণ্ডব পরবর্তী প্রজন্মকে অবচেতনভাবে প্রভাবিত করেনি।


লালন যুদ্ধ ও হিংসাকে জয় করতে চেয়েছিলেন ভালোবাসা দিয়ে, সাধারণ মানুষের ভাষা দিয়ে, লোকসংগীত দিয়ে।
লালন একজন মহান বাঙালি। তাঁকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি ও গায়ক বলে অবমাননা করতে চাই না। কারণ শুধু আহাম্মকরাই প্রতিভার তুলনা করতে পারে। স্বাধীনতা উদ্যানেরই এক পাশে রমনা কালীমন্দিরেই ঘটেছিল ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য হত্যাকাণ্ড একাত্তর সালে। সাম্প্রদায়িকতার দূষিত বাষ্প ওদের বর্বর করে তুলেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে শুধু পাঞ্জাবিই ছিল না, বাঙালিও ছিল। ওই সময়ে তাদের বর্বরতা রূপ নিয়েছিল ওদের রাজনৈতিক দর্শন। আর সেই রাজনৈতিক দর্শনের বীভৎসতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পরেও।
শুনেছি, ২৫ মার্চের কালরাতের পর কিছু সাহসী তরুণ-তরুণী লালন সংগীত গাইতেন স্বাধীনতা উদ্যানে। তাঁদের চারপাশে থাকত অস্ত্রধারী পুলিশ ও সেনাবাহিনী। তাঁরা ভ্রূক্ষেপ করতেন না, গান গাইতেন, চলে যেতেন। সে গান ছিল ভালোবাসার, অহিংসার। আইন রক্ষাকারীরা তাঁদের শ্রদ্ধা করতে শিখেছিল।
অপপ্রচার চালানো হয়েছিল_স্বাধীনতা উদ্যান রূপান্তরিত হয়েছিল মদ, মাদক ও বেশ্যাবৃত্তির কেন্দ্র হিসেবে। আমি তেমন কিছু দেখিনি। আমি এটাকে দেখেছি নিঃস্ব, সম্বলহীন মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে, সর্বহারার দুর্গ হিসেবে। বিভীষিকা, ভীতি ও হত্যা ওদের স্তব্ধ করতে পারেনি। আর অনেক দিন পর স্বাধীনতা উদ্যানে সৃষ্টি হয়েছে লালন চর্চাকেন্দ্র। ছোট্ট একটি কেন্দ্র। গোটা বিশেক পথশিশুকে অক্ষরজ্ঞান শেখান কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক-শিক্ষিকা। আগের লালন চর্চাকারীদের মতো তাঁদের গায়ে গেরুয়া বসন নেই। ওদের পরনে শার্ট-প্যান্ট, সালোয়ার-কামিজ।
যে ছাত্রছাত্রীদের তাঁরা পড়াচ্ছেন তাদের দৈনিক মজুরি দিচ্ছেন ২০ টাকা ঘণ্টায়। তা না-হলে ওরা ফুল বিক্রি বন্ধ করে অক্ষরজ্ঞান নিতে আসত না। কিন্তু এ টাকাগুলো সংগ্রহ করাই হচ্ছে মুশকিল। তাঁরা এ বিষয়ের অবসান করতে চান না। যাঁরা প্রত্যহ উদ্যানে বেড়াতে আসেন তাঁরা অনেকেই ধনাঢ্য, সাহায্য করতে পারেন। করেন কি না জানি না। একজন বললেন, এটা সরকারের কাজ, তাঁদের নয়। আরেকজন বললেন, সরকার পথশিশুদের জন্ম দেয়নি। তাদের মধ্যে রয়েছে ভিন্ন দল ও ভিন্ন মতের মানুষ। কোনো ফরম পূরণ করে সদস্য হতে হয় না।
এমনই করে চলেছিলেন শ্রী চৈতন্য, গুরু লালন শাহ_আর একটি সাংগঠনিক রূপ নিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বভারতীতে। চৈত্রের বালু হাওয়া বয়ে যায়। স্বাধীনতা স্তম্ভের পাশে বসে আছে কানাডা-ফেরত একটি মেয়ে। কী নাম ওর, রেবেকা। ওর পাশে চৈনিক এক বান্ধবী। রেবেকার জন্ম হয়েছে আমেরিকায়_স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক পর। ও হয়তো কোনো দিন স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস করতে আসবে না। তবু বাংলা বলতে পারে, বুঝতে পারে_ঢাকায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে। এর আগে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল মারুফের সঙ্গে। ও পাঁচ বছর আমেরিকায় পড়াশোনা করে এখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। মারুফ ও রেবেকার বয়সের ব্যবধান অনেক।
কিন্তু স্বাধীনতা উদ্যানে যাঁরা ঘুরে বেড়ান তাঁদের অধিকাংশই এ দেশের মানুষ। এ দেশের সন্তান। তাঁরা দেখেছেন কিছু স্বার্থান্বেষী স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেমন করে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে_সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে, রাষ্ট্রযন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে। স্বাধীনতা উদ্যানে আসেন, কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, খোলা বাতাসের সন্ধানে। প্রতি বৃহস্পতিবার লালন চর্চাকেন্দ্রে শিরনি বিতরণ করা হয়_আসে অভাবী মানুষ, ছিন্নমূল মানুষ।
একজন সেদিন ওই উদ্যানেই বললেন, 'লালন এসেছিলেন আমাদের ত্রাতা হিসেবে। তিনি জাত-পাতের ঊধর্ে্ব ছিলেন।' হ্যাঁ, স্বীকার করতে কোনোই দ্বিধা নেই, অবশ্যই লালন ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, খাঁটি বাঙালি। স্বাধীনতা উদ্যানেও লালনকে সে রূপেই দেখেছি।
লেখক : সুইডেন প্রবাসী নৃতাত্তি্বক

No comments

Powered by Blogger.