জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলব by মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

সমকাল : সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তিসহ ৫১টি সুপারিশ ও বিল উত্থাপন করেছে। এর মধ্যে কোন কোন সুপারিশ বিএনপি সমর্থন করে না এবং কেন? ফখরুল :বিএনপি মনে করে, সংবিধান সংশোধন, পরিবর্তন, সংযোজন, প্রণয়নের এখতিয়ার জনগণের নির্বাচিত সংসদের।


আদালতের এখতিয়ার সংবিধানের ব্যাখ্যা করার। অনেক সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে আদালতের রায়ের মাধ্যমে। এ বিষয়গুলো রাজনৈতিক। রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর সমাধান রাজনৈতিকভাবে হওয়া বাঞ্ছনীয়। আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন আমরা সমর্থন করি না। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেশকে চরম রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকার তাদের দলীয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছে। সংবিধান সংশোধনী কমিটি প্রায় একদলীয় অর্থাৎ সরকারদলীয় কমিটিতে পরিণত হয়েছে।
আমরা মনে করি, সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তনের জন্য গণভোটের প্রয়োজন। সংবিধান সংশোধনী কমিটির বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত স্ববিরোধী এবং সাংঘর্ষিক। একদিকে বিসমিল্লাহ ও ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম রাখা হচ্ছে, অন্যদিকে আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস বাদ দেওয়া হচ্ছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে যা সাংঘর্ষিক।
অন্যদিকে সমাজতন্ত্রকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে বললেও মুক্তবাজার অর্থনীতি অন্যতম প্রধান নীতিতে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়গুলো স্ববিরোধী। আমরা মনে করি, এ সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই।
সমকাল : সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে এবং বহাল রাখতে হলে সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পেঁৗছতে হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। আপনার অভিমত কী?
ফখরুল :সুপ্রিম কোর্টের রায় এখনও পূর্ণাঙ্গ প্রকাশিত হয়নি। যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে তাকে প্রধানমন্ত্রী ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বাতিল করা হয়েছে বলেছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছে এবং প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি না হওয়ার পরামর্শ দিলেও তা সংসদের ওপরে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রায়টি বিভক্ত। সুপ্রিম কোর্টের রায় জনগণ ও সংসদের জন্য অবশ্য পালনীয় নয়। বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। এটি রাজনৈতিকভাবেই নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।
সমকাল : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন কোনো ফর্মুলা থাকলে তা পেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রস্তাবে আপনাদের সাড়া দিতে অসুবিধা কোথায়?
ফখরুল :নতুন ফর্মুলার প্রয়োজন নেই। ত্রয়োদশ সংশোধনী সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। যেহেতু সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বিতর্কিত সে জন্য প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে আমাদের দলের চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছেন।
সমকাল : দেশের সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও থিঙ্কট্যাঙ্ক মনে করে, বিএনপির সংসদে যাওয়া উচিত। সাধারণ মানুষের বৃহদাংশও তা-ই মনে করে। এক্ষেত্রে আজও অগ্রাহ্য করে সংসদে না যাওয়া কতখানি যুক্তিযুক্ত?
ফখরুল :বিএনপি তো সংসদ বর্জন করেনি। সংসদে বিএনপি প্রায় ৩ হাজার মুলতবি প্রস্তাব ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য নোটিশ দিয়েছিল। স্পিকার একটিরও আলোচনার সুযোগ দেননি। সংসদে অশালীন ভাষায় কথা বলা হয়। পরিবেশ অত্যন্ত কুৎসিত। সরকারি দলের দায়িত্ব হচ্ছে সংসদে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিএনপি একটি কার্যকর সংসদ দেখতে চায় বলেই একটি বিতর্কিত নির্বাচনে বিজয়ী সরকারকে মেনে নিয়েই সংসদে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু সরকার বিরোধী দলকে সংসদে থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়নি।
সমকাল : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখলে আলোচনায় বসতে রাজি বলে জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগও সংসদের ভেতর বা বাইরে আলোচনায় বসতে রাজি বলে জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে কি 'বরফ' গলার পূর্বাভাস বলা যায়?
ফখরুল :পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে সরকারি দলের ওপর। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান মেনে নিলেই পরবর্তী আলোচনা সম্ভব। তাছাড়া আলোচনা কখন, কোথায় এবং কীভাবে হবে_ কিছুই জানানো হয়নি বিএনপিকে। আসলে সরকার আলোচনার কথা বলে সরকারি দল জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক কথা বলছেন, অন্যদিকে সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলছেন ভিন্ন কথা।
সমকাল : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারি দলের সঙ্গে আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে আলোচনার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে আপনাদের বক্তব্য কী হতে পারে?
ফখরুল :বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তব্যই দলের বক্তব্য। আলোচনায় বসলে তখন আমাদের বক্তব্য তুলে ধরা হবে।
সমকাল : সর্বদলীয় সংবিধান সংশোধন কমিটিতে বিএনপি অংশ নেয়নি? সেখানে কি সংশোধনের প্রতিবাদ করা যেত না?
ফখরুল : বিএনপিকে মাত্র একটি সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল।
সমকাল : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন উচ্চ আদালতের রায়ের একাংশ মেনে নিয়েছেন। তারা আশা করেন, বাকি অংশও মেনে নেবেন। আপনার বক্তব্য কী?
ফখরুল : কিসের ভিত্তিতে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি মেনে নিলেই তো আর সমস্যা থাকে না।
সমকাল : বিএনপি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আলোচনায় না এলে আওয়ামী লীগ সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করেই নির্বাচন করবে এবং ওই নির্বাচনে বাধা দেওয়ার মতো ক্ষমতা বিএনপির নেই বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
ফখরুল :আওয়ামী লীগ একদলীয় নির্বাচন করার জন্য তো এ কৌশল নিয়েছে। জনগণের আস্থা হারিয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছে, ক্ষমতায় তারা আর আসতে পারবে না যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। জনগণ সেই নির্বাচন মেনে নেবে না।
সমকাল : বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগামী নির্বাচন পরিচালনা করবে না। তবু কেন বর্তমান ইসি নিয়ে এত কিছু বলছেন?
ফখরুল :কারণ আমরা নিরপেক্ষ ইসি চাই।
সমকাল : ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোট হচ্ছে। এ পদ্ধতি নিয়ে আপনাদের বিরোধিতার কারণ কী?
ফখরুল :ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে কারচুপির সুযোগ অনেক বেশি। আমেরিকাসহ অনেক উন্নত দেশ এখন এ পদ্ধতি বাদ দিচ্ছে এর দুর্বলতার জন্য।
সমকাল : সরকার আপনাদের দাবি না মানলে সেক্ষেত্রে আপনারা কী করবেন?
ফখরুল :জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলব।
সমকাল : অনেকে মনে করেন, মাত্র আড়াই বছরের মাথায় মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার মতো এখনও যুক্তিসঙ্গত সময় হয়নি। একই সঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাও রয়েছে। আপনার মূল্যায়ন কী?
ফখরুল :মহাজোট সরকার নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে প্রদত্ত একটি প্রতিশ্রুতিও পূরণ করতে পারেনি। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার ও অভিযুক্তদের দণ্ডাদেশ কার্যকর করা তাদের একমাত্র সাফল্য। সরকার একের পর এক গণবিরোধী কাজ করে চলেছে। দেশের অর্থনীতি, বিচার ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী দুঃশাসনের কারণে। তাই আমরা মনে করি, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য, অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য আওয়ামী লীগ যত দ্রুত ক্ষমতা ছাড়ে ততই মঙ্গল।
সমকাল : বিএনপির পরবর্তী কী কর্মসূচি আসতে পারে?
ফখরুল :সব ধরনের গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি আসতে পারে।
সমকাল : দেশের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বর্তমানে বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ফখরুল :বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষা, গণতন্ত্রকে সুসংহত করা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
সমকাল : বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
ফখরুল :বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নিজেদের সামর্থ্য তৈরি করার লক্ষ্যে বিএনপিকে গড়ে তোলা। গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
 

No comments

Powered by Blogger.