নিভৃতচারী মায়েদের গল্প by নাজনীন তৌহিদ

একসময় মায়েরা নকশিকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে জীবনের কত না ছবি আঁকতেন! কখনোবা কুরুশকাঠির সুতায় বোনা নানা রঙের পোশাকে সাজাতেন সন্তানকে। কেউ পাটি বুনতেন, কেউ শিকা বানাতেন, ঝুড়ি বানাতেন কিংবা নকশি পাখার ভাঁজে ভাঁজে ফোটাতেন জীবনের ছন্দ। সময়ের চাহিদার ভিড়ে এসব স্মৃতি মন্থর হলেও মুছে যায়নি এখনও।


হয়তোবা রূপ পাল্টেছে সেসব ব্যবহার্য হস্তশিল্পের। যুগের চাহিদায় মায়েরা তবু পিছিয়ে পড়েননি, বরং নিজেদের হাতকে তারা আরও সবল করে তুলেছেন। ঘরের চাহিদা মিটিয়ে মায়েরা সংসারের বাড়তি রোজগারেও নিজেদের শখের নেশাকে পেশায় পরিণত করেছেন আজ। হয়তো কেউ পেয়েছেন স্বীকৃতি, কেউ পাননি। তবু নিভৃতে ঝরিয়ে চলেছেন তাদের ঘাম। এ শহরের ব্যস্ত জীবনযাপনের মধ্যে পথ চলতে হঠাৎ থমকে গেলাম এক দিন। কোনো একটি স্কুলগেটের পাশে অলস দুপুরকে সরস করতে বসে আছেন কয়েকজন মা। কী নিয়ে ডুবে আছেন তারা_ এ কৌতূহল নিয়ে তাদের কাছে এলাম। নিছক গল্পে মেতে নেই তারা। প্রিয় সন্তানকে ক্লাসে পাঠিয়ে মা অপেক্ষা করছেন। এটি নিত্যকার ব্যাপার। অথচ এ মায়েরা সময়ের মূল্য জানেন। সংসারের অচল চাকার হতাশার মাঝে ডুবে থাকা নয়, এ সত্যটি উপলব্ধি করেই জীবনকে করেছেন সোচ্চার। জোগান দিচ্ছেন সংসারের বাড়তি খরচ। সন্তানের আবদার একটি আইসক্রিম কিংবা এক টুকরা কেকের টাকার জন্য এখন আর চোখের জল ফেলতে হয় না তাদের।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাওয়া টানাপড়েনের সংসারে মায়েরা যেন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন, যদিও তাদের আয় হাতেগোনা ক'টি টাকা মাত্র। তবুও তো কিছু আসছে! হয়তোবা সন্তানের টিফিনের সঙ্গে বই-খাতা কেনার অর্থ জোগাড় হবে! এসব আশা নিয়েই এই মায়েরা বুনে চলছেন প্লাস্টিকের ক্যান বা সুতা দিয়ে নানা রঙবেরঙ আর বাহারি ধাঁচের হ্যান্ডব্যাগ, শোপিস কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো বস্তু। এসব ব্যাগের কদর শহরজুড়ে, বিশেষ করে তরুণীদের পছন্দের শীর্ষে থাকছে।
অবাক হলাম তাদের নিপুণ হাতের কাজ দেখে। এসব মায়ের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। একজন আরেকজন থেকে দেখে দেখে শেখা। আর প্রতিবেশীদের মধ্যে দু'একটি বিক্রি করে সামান্য টাকা সংসারের খরচের তালিকায় জোগান দেওয়া। মনে মনে আফসোস হলো, আহা, তারা যদি হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ পেতেন কিংবা সামান্য পুঁজি সংগ্রহ করতে পারতেন!
এই কাজের সঠিক মূল্যায়ন পেলে হয়তোবা তারা অনেক দূর এগোতে পারতেন! তাদের মতো অনেক নারী আছেন, যারা আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ চান; কিন্তু পান না। তাদের প্রয়োজন শুধু সহযোগিতার হাত। এক দিন হয়তো কেউ সে হাতকে প্রশস্ত করবে সে আশায় তাদের কিছু ছবি তুলে ধরলাম। তাদের সরল কথা, দেশ তাদের কিছু দিলে তারাও দেশকে কিছু দিতে পারবেন। আর এভাবেই হয়তো দেশ সমৃদ্ধির পথে পা বাড়াবে এক দিন।
nazneentowhid@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.