কল্পকথার গল্প-ক্ষণস্থায়ী তর্জন-গর্জন-বর্জন by আলী হাবিব

অলিভার ক্রমওয়েল নামে এক ইংরেজ শাসক ছিলেন। তিনি নিজেকে সব কিছুর ঊধর্ে্ব মনে করতেন। তিনি যা কিছুই করতেন, সব কিছুই সঠিক বলে মনে করা হতো। তিনি ছাড়া আর কেউ ভালো কিছু করতে পারে_এটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। সেই অলিভার ক্রমওয়েলের প্রেতাত্মা আমরা বাংলাদেশেও দেখেছি।


এখানেও কোনো একজন সম্পর্কে মনে করা হয়, তিনিই সব কিছুর নেপথ্যের কারিগর। যেমন আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতার কথাই ধরা যাক। আমরা সবাই জানি, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ এক দিনে শুরু হয়ে যায়নি। এটা তো আর ফুটবল খেলা নয় যে রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দিলেন আর খেলা শুরু হয়ে গেল। স্বাধীনতার জন্য জাতিকে প্রস্তুত করতে হয়েছে। তারপর ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু জাতিকে আহ্বান জানালেন, 'যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত' থাকতে। আহ্বান জানালেন 'ঘরে ঘরে দুর্গ' গড়ে তোলার। সেই দিন থেকেই বাংলার প্রতিটি ঘর দুর্গ হয়ে গেল। ২৬ মার্চ তিনি দিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন অনেকেরই নৈতিক পরিবর্তনও ঘটিয়ে দিল। তার পর থেকে শুরু করে রাজনীতিতে আজকাল নানা কথাবার্তা হচ্ছে। বর্তমান সরকার একটি স্থির লক্ষ্য নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে, সেটা স্পষ্ট। অন্যদিকে সরকার যা কিছুই করুক না কেন, সেটাই মন্দ_এমন প্রচারও চলছে অবিরল। আমাদের দেশে এক অদ্ভুত ডেমোক্রেসিও ছিল। যার বদৌলতে গণতন্ত্র থাকলেও মধ্যরাত থেকে সান্ধ্য আইন চলত। তাকে বলা হতো 'কারফিউ ডেমোক্রেসি'। সেই 'কারফিউ ডেমোক্রেসি' আজ নেই। কিন্তু 'কার্ফিউ ডেমোক্রেসি' থেকে ক্ষমতাবান দলটি তো আছে। দলের ডিগবাজিপ্রবণ নেতারাও অনেকে স্বরূপে দলে বিরাজমান। ক্ষমতা তাঁদের হাতে নেই। আছে তর্জন-গর্জন। বর্জনের হুমকি আছে। অর্জন বলতে কিছু নেই।
পুরনো একটা গল্পে যাওযা যাক। এক পিঁপড়ে ও এক ঘাসফড়িংয়ের গল্প। পুরনো গল্পটা ছোট। গরমের সময় একটা পিঁপড়ে তার নিজের জন্য একটা বাড়ি বানাল। শীতের জন্য রসদ জোগাড় করল। বাড়িতে সব খাবার জমা করল। একটা ঘাসফড়িং সব সময় নেচে নেচে বেড়াত। পিঁপড়ে খাবার জোগাড় করছে দেখে সে ভাবল, পিঁপড়েটা কী বোকা! আনন্দে সময়টা না কাটিয়ে খাবার জোগাড় করে বেড়াচ্ছে। শীত এল। দেখা গেল, পিঁপড়েটা সময়মতো ঠিক তার বাসায় গিয়ে ঢুকল। পুরো শীতকালটা সে ওই বাড়িতে কাটিয়ে দিল জমানো খাবার খেয়ে। ওদিকে নিজের একটা বাড়ি না থাকায় ঘাসফড়িংটা শীতে কোথাও থাকার জায়গা পেল না। আগে থেকে খাবার সংগ্রহ করে না রাখায় না খেতে পেয়ে ক্ষুধায় ও শীতে একসময় সে মরেই গেল।
গল্পটির একটি আধুনিক সংস্করণ হয়েছে। সে গল্পটা বলা যাক। একটা পিঁপড়ে তার নিজের জন্য একটা বাড়ি বানাল। শীতের জন্য রসদ জোগাড় করল। বাড়িতে সব খাবার জমা করল। একটা ঘাসফড়িং সব সময় নেচে নেচে বেড়াত। পিঁপড়ে খাবার জোগাড় করছে দেখে সে ভাবল, পিঁপড়েটা কী বোকা! আনন্দে সময়টা না কাটিয়ে খাবার জোগাড় করে বেড়াচ্ছে। শীত এল। দেখা গেল, পিঁপড়েটা সময়মতো ঠিক তার বাসায় গিয়ে ঢুকল। ঘাসফড়িং দেখল, তার তো ভারী বিপদ হয়ে গেল। সে এবার সংবাদ সম্মেলন ডাকল। সংবাদ সম্মেলন ডেকে সে সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রশ্ন তুলল, কেন একটা পিঁপড়ে এভাবে সুযোগ পাবে? কেন সে একাই আরাম করে ঘরে থাকবে? কেন পিঁপড়ের ঘরেই কেবল খাবার থাকবে? কেন ঘাসফড়িংয়ের ঘরে থাকবে না। ব্যস শুরু হয়ে গেল আলোচনা। টেলিভিশনের চ্যানেলে চ্যানেলে টকশো। সেখানে আপাতগম্ভীর আলোচকরা আলোচনা করলেন। বিশ্লেষণ করলেন। অনেকেই প্রশ্ন তুললেন_ তাইতো, সুযোগটা একা কেন পিঁপড়ে পাবে। পিঁপড়ে যে দিনের পর দিন একা একা কাজ করেছে। নিজের মতো করে সব কিছু গুছিয়েছে, সেটা কেউ আলোচনায় আনতেই চাইল না। কেউ বলছে, ঘাসফড়িং প্রকৃতির এক অনবদ্য সৃষ্টি, সে কেন এভাবে বঞ্চিত হবে। কেউ বলল, প্রকৃতিকে রাঙিয়ে রাখে এই ঘাসফড়িং। সব সময় নেচে বেড়ায়, সে কেন শীতের সময় এভাবে একটা থাকার ঘর ও খাবার থেকে বঞ্চিত হবে? বিদেশ থেকে অনেককে ভাড়া করে আনা হলো। যেহেতু ঘাসফড়িংয়ের পক্ষে ভাড়া করে আনা হলো। মামলা হলো। একসময় পিঁপড়ের সাধের বাড়ি চলে গেল ঘাসফড়িংয়ের দখলে। টেলিভিশনে নুতন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। বলা হলো, নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। এখানে সবার সমান অধিকার। কোনো কিছুই কারো একক সম্পত্তি নয়। পিঁপড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। পিঁপড়ে যে বাড়িটা বানিয়েছিল, সেই বাড়িটা চলে গেল ঘাসফড়িংয়ের দখলে। সে পিঁপড়ের সংগ্রহ করা খাবার খেতে লাগল। ওই বাড়ি, বাড়িতে রাখা খাবার_সবই ছিল পিঁপড়ের অর্জন। সবই চলে গেল ঘাসফড়িংয়ের দখলে। কয়েক দিন পর দেখা গেল, বাড়িটা বিবর্ণ হয়ে গেল। কারণ, বাড়িটা তো আর ওর তৈরি করা ছিল না। দখল করা বাড়ি। কাজেই সে জানত না, কেমন করে সেই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়।
প্রতিটি গল্পের মতো এই গল্পেও একটা শিক্ষণীয় বিষয় আছে। কী সেটা? যারা যেটাতে অভ্যস্ত নয়, তারা তা সুন্দরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে না। গণতন্ত্রের ভেতর দিয়ে যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠার ইতিহাস নেই, তাদের কাছে নিশ্চয়ই গণতন্ত্র নিরাপদ থাকতে পারে না। কারণ, গণতন্ত্র পরিচর্যার সংস্কৃতি তাঁদের নেই। আর তাঁদের কাছে যে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে, তার ইতিহাসও তো আমাদের অজানা নয়। গণতন্ত্রের চর্চা না করে, তাদের তর্জন-গর্জন-বর্জন, সব কিছুই যে কেবল গল্পের ওই ঘাসফড়িংয়ের মতো নগদ প্রাপ্তিযোগের আশায়, সেটা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে তাঁদের এই তর্জন-গর্জন-বর্জন সব কিছুই বড় ক্ষণস্থায়ী।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.