কম্পানি আইনের সংশোধন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

সম্প্রতি শেয়ারবাজারের বিপর্যয়ের পর একে সক্রিয় করার জন্য সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশের দুটি স্টক এক্সচেঞ্জই শতভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সুশাসনের অভাবে কোনো বিপর্যয় ঘটলে তার দায়দায়িত্ব স্টক এক্সচেঞ্জের ওপর বর্তানোর কথা। কিন্তু তেমনটি ঘটেনি।


এর কারণ একাধিক। প্রথমত, স্টক এক্সচেঞ্জের কিছু সক্রিয় রাজনৈতিক সদস্য দলীয় পরিচয়কে ব্যবহার করে একটা ভ্রান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিলেন এবং এর ফলে সরকার জড়িয়ে পড়েছে। এ রকম একটা কথা বাজারে চলছে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ার কেলেঙ্কারি ঘটে। কিছুটা হলেও এ ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। দ্বিতীয়ত, স্টক এক্সচেঞ্জে করপোরেট শাসন নেই। এটি সদস্য প্রতিষ্ঠান। সেই ঐতিহ্যেই সব কিছু চলছে। অন্যথায় সিইওকে কাঠগড়ায় উঠতে হতো। বিভিন্ন পদক্ষেপের ভেতর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তালিকাভুক্ত কম্পানিকে তার নিজস্ব শেয়ার কেনার অনুমতি দেওয়া হবে। শেয়ারের দাম যদি অস্বাভাবিক গতিতে কমে যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কম্পানি নিজের শেয়ার কিনবে কেন, তা অনুধাবন করা খুবই সহজ।
এটি অতি পুরনো কথা। কোনো দ্রব্যের সরবরাহ কমলে তার মূল্য হয় বাড়বে, না হয় স্থিতিশীল হবে। এটা একেবারে ফ্রি রাইড হতে পারে না। কিছু বিধিনিষেধ থাকতে হবে। প্রথমত, সাধারণত কম্পানির ফ্রি রিজার্ভ অথবা প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করা হয়। এ রকম অনুমতি দেওয়া সমীচীন হবে না যে জরুরি ভিত্তিতে কোনো পরিচালকের কাছ থেকে ধার নিয়ে এই শেয়ার কেনা যাবে। ফলে ভবিষ্যতে অন্য রকম জটিলতা দেখা যেতে পারে। কম্পানির সংঘস্মারকে এই বিধানের কথা থাকতে হবে। এজিএমে অনুমোদন নিতে হবে। মোট পরিশোধিত মূলধনের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার কেনা যেতে পারে। একটি কম্পানির শেয়ারের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে এই অস্ত্র প্রয়োগ করা যাবে, এ রকম একটা সাধারণ ধারণা যেন কাজ না করে। এখানে আরো কিছু বিষয় আছে। যে শেয়ার কেনা হলো, তার বিপরীতে কি লভ্যাংশ দেওয়া যায়? যদি লভ্যাংশ না দেওয়া হয়, তাহলে অবশিষ্ট শেয়ারের লভ্যাংশের পরিমাণ বেড়ে যায়। কেননা, শেয়ারের সংখ্যা কমে আসছে। সে ক্ষেত্রে এমন হতে পারে যে শেয়ার বাইব্যাক করার অস্ত্র প্রয়োগ করতে প্রলুব্ধ করার জন্য চক্রান্ত করে শেয়ারমূল্যে ধস নামানো হলো। অতএব শেয়ার মূল্যে ধস নামার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত তদন্ত করা প্রয়োজন। অবশ্য সামগ্রিকভাবে শেয়ারবাজারে ধস নামলে আলাদা কথা। কিন্তু যদি এককভাবে কোনো কম্পানির এ অবস্থা হয়, তাহলে কারো না কারো প্রতি সন্দেহের তীর ছোড়ার প্রশ্ন এসে যায়। যাঁরা এ ব্যবস্থা চালুর দায়িত্ব পাবেন, তাঁরা সব প্রশ্নই খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু তার আগে কম্পানি আইনে এই বিধান থাকতে হবে। বর্তমান কম্পানি আইন ১৯৯৪ সালে চালু করা হয়। ১৯১৩ সালে ইংরেজ শাসক কর্তৃক প্রণীত কম্পানি আইন পাকিস্তান সরকার গ্রহণ করে। বাংলাদেশেও সেই আইন চলতে থাকে। '৯৪ সালে যখন বাংলাদেশে নতুন কম্পানি আইন গৃহীত হয়, তখন দেশে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের রাজত্ব ছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। ১৯৯৪ সালের আইনে অ্যাকাউন্টস সম্পর্কে এত খুঁটিনাটি বিষয় বাৎসরিক প্রতিবেদনে জানতে চাওয়া হয়েছে যে, এ সম্পর্কে দু-একজন সিএকে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখেছি। অথচ কম্পানি আইনটি এতিম। এর কোনো অভিভাবক নেই। কম্পানি আইনে কোনো প্রতিকার চাওয়ার স্থান নেই। সুপ্রিম কোর্টে তো সব আইনের বিষয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিকার চাওয়া যায়। সেটা ভিন্ন কথা। '৯৪-এর আইন চূড়ান্ত করার আগে একটা প্রস্তাব এসেছিল যে একটি কম্পানি ল' বোর্ড থাকা প্রয়োজন, যার প্রধান হবেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের পদমর্যাদার একজন। কিন্তু এসব কোনো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
যেসব কম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত, পুঁজি বাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) তাদের ওপর কিছু খবরদারি করে। এ ছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জেরও কিছু নজরদারি রয়েছে। যে কারণে আজকাল তালিকাভুক্ত কম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম সময়মতো অনুষ্ঠিত হয়। এজিএম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কম্পানির বার্ষিক হিসাব-নিকাশ উপস্থাপন করা হয়। পরিচালক নির্বাচন এবং অডিটর নিয়োগ দেওয়া হয়। তাতে সাধারণ শেয়ার হোল্ডাররা স্বাধীনভাবে বক্তব্য পেশ করতে পারে; কিন্তু এর বাইরে কম্পানি প্রশাসন থাকে অন্ধকার গহ্বরে।
ধরা যাক, একজন উৎসাহী উদ্যোক্তা কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্রাইভেট লিমিটেড কম্পানি চালু করলেন। ইতিমধ্যে তাঁদের ভেতর কেউ রাজনৈতিক বা অন্য কারণে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। এরপর চাপ দিয়ে সিংহভাগ শেয়ার নিজের নামে লিখিয়ে নিলেন। এতে অন্য কারো কিছু করার থাকে না। আগে বেসরকারি ব্যাংকের কার্যকলাপ খুব সুষ্ঠু ছিল। এখন আর সে রকম নেই। আমার এক বন্ধু কম্পানির চেয়ারম্যান। তিনি অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে রিপোর্ট চাইলে বলা হলো যে এমডি এমবার্গো দিয়ে রেখেছেন। এদিকে যৌথ স্বাক্ষরে অ্যাকাউন্ট পরিচালনার নির্দেশ থাকলেও একক স্বাক্ষরে তা পরিচালিত হচ্ছে। এভাবে চলছে বিশৃঙ্খলা।
বাংলাদেশের কম্পানি আইনে দুই ধরনের কম্পানির বিধান রয়েছে। একটি হলো প্রাইভেট লিমিটেড কম্পানি এবং অন্যটি পাবলিক লিমিটেড কম্পানি। এ ছাড়া এক ধরনের কম্পানি রয়েছে, যার মালিকানার শতভাগ সরকারের। এখানে এ রকম কয়েকটি কম্পানিকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানি হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। অথচ সব শেয়ার সরকারের খাতায় থাকলেও আমলারা তার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। পাবলিক লিমিটেড কম্পানির যে সংজ্ঞা আইনের বইয়ে দেওয়া আছে, তা অপ্রতুল এবং অস্পষ্ট। সেই সুযোগটা নেওয়া হয়ে থাকে। এমনিতেই আমাদের যেকোনো আইন মানার চেয়ে বাইপাস করে চলার মানসিকতা এবং দক্ষতা অত্যন্ত বেশি। আর তা যদি অপ্রতুল হয়, তাহলে তো কথাই নেই। ভারতে এত চতুরতার চেষ্টা করা হয়নি। সেখানে সরকারের মালিকানাধীন কম্পানি নামক একশ্রেণীর কম্পানির কথা বলা হয়েছে। আর সে কম্পানির পরিচালনা সম্পর্কেও আইন অনুসরণ করার জন্য কিছু নির্দেশ রয়েছে। কম্পানির বিলুপ্তি বা অবসায়নের বিধিও খুব গতিশীল হওয়া দরকার। এসইসি অবশ্য রুগ্ণ কম্পানির জন্য ওটিসি মার্কেট করেছে, যাকে বলা হয় ওভার দি কাউন্টার মার্কেট। আসলে ওটিসি মার্কেটের উদ্দেশ্য যেসব কম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হতে পারে না বা হতে চায় না, তারা এ মার্কেটে আসবে। এর ব্যবস্থাপনাও আলাদা হবে। কিন্তু এসইসি এ মার্কেটকে স্টক এক্সচেঞ্জের একটি কাউন্টারের রূপ দিয়েছে।
মোট কথা, সময়ের দাবি মেটানোর জন্য এবং যুগোপযোগী করার জন্য কম্পানি আইনের বেশ কিছু সংশোধনের প্রয়োজন। তা হতে হবে ব্যাপকভিত্তিক।
বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটিকে এ কাজ করতে হবে। অতএব আমাদের প্রত্যাশা, সরকার এবং বিরোধী দল উভয়ে আগ্রহ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে আইনটি সংশোধন করবে। যত দ্রুত কাজটি হবে, ততই মঙ্গল।

লেখক : সাবেক ইপিএস, কলামিস্ট ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.