ভূমিকম্প-মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর উপায় by আলী আকবর মলি্লক

ভূমিকম্পপ্রবণ দেশে কম ওজনের হলেও ব্রিক বা ব্লক ব্যবহার করা ভালো, যাতে ভবনের ওজন অপেক্ষাকৃত কম হয় এবং ওয়াল তৈরিতে শুধু মর্টারই নয় সঙ্গে রড দিয়েও গেঁথে দেওয়া যায়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ঘটা দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েকটির পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমাদের অবস্থা যেন হাইতির মতো না হয়ে চিলির মতো হয় তা ভাবা দরকার।


হাইতি ও চিলির উদাহরণ মনে রেখে হলেও বাংলাদেশে যে কোনো কাঠামো নির্মাণে ভূমিকম্পের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখতে হবে। এ জন্য স্থাপনার মালিকের বাড়তি কিছু পয়সা খরচ করার সদিচ্ছা থাকতে হবে

যারা ভূমিকম্প নিয়ে একটু বেশি ভাবেন তাদের কাছে প্রতি বছর ১২ জুন একটি বিশেষ বার্তা নিয়ে আসে। ১৮৯৭ সালের এই দিনটিতে ভারতের আসাম বেসিনে রিখটার স্কেলে আটের অধিক মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঘটেছিল, যা 'দি গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক' নামে পরিচিত। ঢাকা থেকে দূরত্ব ছিল মাত্র ২৫২ কিলোমিটার। এটি পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ঘটা মহাপ্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে একটি। উৎপত্তি হয়েছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩২ কি.মি. গভীরে, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল প্রায় চার লাখ বর্গকিলোমিটারজুড়ে। আসাম, ত্রিপুরা, ধুবড়ি, শিলং, পূর্ববঙ্গে ইটের তৈরি মসজিদ-মন্দির, রাজবাড়ী বিধ্বস্ত হয়েছিল। ঢাকার আহসান মঞ্জিল, দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং নাটোরের রাজবাড়ীর একাংশ বিধ্বস্ত হয়েছিল। লোক মারা যায় ১,৫৪২ জন। লন্ডন টাইমসে ১৪ জুন থেকে ১০ আগস্টের মধ্যে ৭টি সংখ্যায় এবং নিউইয়র্ক টাইমসে ১৪ জুন ১৮৯৭ এই ভূমিকম্পটির বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
ভূগর্ভে থাকা ফাটল বা চ্যুতিতে পুঞ্জীভূত শক্তি ছেড়ে দেওয়ার ফলে ভূমিকম্প হয়। যে চ্যুতিতে একবার ভূমিকম্প ঘটে সেই চ্যুতিতে পুনর্বার শক্তি সঞ্চয় হতে থাকে। তাই বয়স যত বাড়তে থাকে ওই চ্যুতিতে পুনর্বার ভূমিকম্প ঘটার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। তবে পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয় হতে চ্যুতিভেদে সময় কমবেশি লাগে। ১২ জানুয়ারি ২০১০ সালে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক শূন্য মাত্রার ঘটা হাইতির ভূমিকম্পটির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। ওই একই স্থানে ৩ জুন ১৭৭০ সালে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঘটেছিল। অর্থাৎ প্রায় ২৪০ বছর পর ভূমিকম্পটির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। হাইতিতে ১২ জানুয়ারির ভূমিকম্পে ৩ লাখ ১৬ হাজার লোক প্রাণ হারায়। পক্ষান্তরে চিলিতে ২৭ ফেরুয়ারি ২০১০ সালে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঘটে। সেখানে মাত্র এক হাজার লোক প্রাণ হারায়। অথচ চিলির ভূমিকম্পটি হাইতির থেকে ৫০১ গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল। ক্ষয়ক্ষতির আকাশ-পাতাল তফাতের অন্যতম কারণ চিলি কড়াকড়িভাবে বিল্ডিং কোড মেনে চলে কিন্তু হাইতির বিল্ডিং কোডই নেই এবং চিলি হাইতির চেয়ে অনেক বেশি সচ্ছল ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল দেশ।
ভূমিকম্প সহনশীল স্থাপনা নির্মাণে অতীব গুরুত্বের বিষয় হচ্ছে, মাটির পরীক্ষা, স্থাপনার সঠিক নকশা প্রণয়ন, কাঠামোর ডিজাইন এবং সঠিক মানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার। নকশা প্রণয়ন এবং কাঠামো ডিজাইনের সময় গুরুত্ব দিতে হবে স্থাপনার সমতল ও উল্লম্ব উভয় দিকের সমবিন্যাসের ওপর। একটি জাহাজ নির্মাণের পর যখন পানিতে ভাসানো হয় তখন সহজেই ধরা পড়ে জাহাজটি কোনো একদিকে কাত হলে। ভবন বা সেতুর মতো স্থাপনা জাহাজের মতো পানিতে ভাসানোর সুযোগ নেই বিধায় এদের নকশা যদি অসম-বিন্যাসে করা হয়ে থাকে তবে তা খালি চোখে ধরা পড়ে না। ভবনে উল্লম্ব দিকের কয়েকটি ত্রুটি সম্পর্কে তুলে ধরছি :
১. সফ্ট-স্টোরি :ভূমিকম্পের ফলে একটি ভবনের প্রতিটি তলায় বক্রনীয় এবং কর্তনীয় পীড়ন কাজ করে। উভয় পীড়ন সবচেয়ে বেশি কাজ করে ভবনের নিচতলায়। ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের তলায় শুধু কলাম থাকলেও আবাসিক তলাগুলোতে কলামের সঙ্গে থাকছে ইটের তৈরি অনেক দশ ইঞ্চি বা পাঁচ ইঞ্চি ওয়াল। যেহেতু বসবাসের তলাগুলোতে বিম-কলামের আরসিসি ফ্রেম এবং এই ফ্রেমের মধ্যে ইটের ওয়াল করা হয় তাই এ তলাগুলো বক্রনীয় পীড়ন সামান্য কিছুটা বেশিমাত্রায় এবং কর্তনীয় পীড়ন অনেকটা বেশিমাত্রায় সহনশীল। পক্ষান্তরে কার পার্কিং তলাতে ওয়াল না থাকাতে এই তলার কর্তনীয় পীড়ন সহনশীল শক্তি অনেক কম। তাই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট পীড়ন সহনশীলতায় কার পার্কিং তলাটি আবাসিক তলার থেকে দুর্বল, যাকে প্রকৌশলের ভাষায় 'সফট-স্টোরি' বলে। ভূমিকম্পের সময় দুর্বল জায়গায় শক্তি কেন্দ্রীভূত হয় বলে সফট-স্টোরিটিতে শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়ে ভবন বিধ্বস্ত করে। পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া বড় মাত্রার ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত ভবনের বড় অংশ বিধ্বস্ত হয়েছে সফট-স্টোরি ত্রুটির কারণে। যেমন ১৭ আগস্ট ১৯৯৯ তুরস্কের কোকায়েলি আর্থকোয়েকে (রিখটার স্কেলের মাত্রা ৭ দশমিক ৪) বা ২৬ জানুয়ারি ২০০১ ভারতে গুজরাট আর্থকোয়েকে (রিখটার স্কেলে মাত্রা ৭ দশমিক ৬) সফট-স্টোরির কারণে অনেক ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া জাপান, ক্যালিফোর্নিয়া, মেক্সিকো, তাইওয়ানের ভূমিকম্পেও একই চিত্র দেখা গেছে। তাই গাড়ি পার্কিংয়ের উদ্দেশ্যে খোলা রাখা তলাগুলো আবাসিক তলার মতো মজবুত করে নির্মাণ করা জরুরি। বহির্ভাগের কলামগুলোর সঙ্গে আরসিসির শিয়ার ওয়াল বা আরসিসির ব্রেসিং বা উভয়ই নির্মাণ করে গাড়ি পার্কিং তলাটিকে মজবুত করা যায়। এ ছাড়া সিঁড়ির ঘর বরাবর আড়াআড়িভাবে থাকা কলামগুলোর সঙ্গে আরসিসি শিয়ার ওয়াল বা ব্রেসিং নির্মাণ করা যায়। এসব কী পরিমাণ এবং কতটা মজবুত করে নির্মাণ করতে হবে তা কাঠামো ডিজাইনার হিসাব করবেন। যেসব ভবন দুর্বল তলা নিয়ে নির্মিত হয়ে আছে সেগুলোকে রেট্রোফিটিং করে ঠিকঠাক করা যায়। দুর্বল তলার বহির্ভাগের গ্রেড বিম, মাথার ওপরের বিম এবং কলামকে জ্যাকেটিং করে তার সঙ্গে আরসিসি শিয়ার ওয়াল বা আরসিসি ব্রেসিং নির্মাণ করে দুর্বল তলার শক্তি বাড়ানো যায়।
২. ফ্লাট-প্লেট :অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ফ্লাট-প্লেট দ্বারা সাধারণ ভবন নির্মিত হতে। আরসিসি কলামের সঙ্গে বিম না রেখে অপেক্ষাকৃত পুরু আরসিসির স্লাব করা হয়, যাতে ক. ফ্লাটের রুমের বিন্যাস সহজ হয়; খ. বিম ছাড়া ভবন গুড লুকিং হয় এবং গ. নির্মাণ কাজ সহজ হয় ও কম সময় লাগে। ফ্লাট-প্লেটের বক্রনীয় শক্তি কলামের বক্রনীয় শক্তির তুলনায় অনেক বেশি বলে এসব ভবন ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ। তার কারণ হলো, ভবনের উচ্চতা যত বাড়ে কলামের মাপ তত বাড়লেও ফ্লাট-প্লেটের পুরুত্ব একই থাকে। প্রায় দ্বিগুণ পুরু করে তৈরির ফলে স্লাবের ভরও দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং এই অতিরিক্ত ভরের কারণে ভূমিকম্পের মুহূর্তে ভবনের প্রতিটি তলায় বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের পার্শ্বশক্তি কাজ করে এবং ভবনকে ধরাশায়ী করতে সাহায্য করে। তাই ফ্লাট-প্লেট নয়, সাধারণ বিম-স্লাব দ্বারা ভবন নির্মাণ করতে হবে। তবে বহুতল কার পার্কিং, রেল বা বাস স্টেশনের প্লাটফর্ম ইত্যাদি কাঠামো নির্মাণে একটি কলাম থেকে পার্শ্ববর্তী কলামগুলোর দূরত্ব বেশি রাখতে হয় এবং কার পার্কিং তলার উচ্চতা কম রাখলে চলে বিধায় মাথার ওপর বিম অনভিপ্রেত। তাই এসব স্থাপনা নির্মাণে সাধারণত ফ্লাট-প্লেট পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এসব স্থাপনা নির্মাণে ফ্লাট-প্লেটগুলো যেমন পুরু করে নির্মাণ করা হয়, তেমনি কলামগুলোও অধিক বড় আকারে নির্মাণ করা হয়।
৩. কলামের চেয়ে বিম শক্তিশালী :অনেক ভবনে দেখা যায়, বিমের আকার কলামের চেয়ে বেশি বা প্রায় সমান। বাংলাদেশে দশ ইঞ্চি ইট ব্যবহার করা হয় বলে কলামকে তার অন্তত এক বাহুকে দশ ইঞ্চি রেখে ডিজাইন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ওয়ালের সঙ্গে কলামকে মেলানো, যাতে প্লাস্টারিং করার পর কলামকে আলাদা করে দেখা না যায়, যেটা গুড লুকিং। আবার বিমের প্রস্থও দশ ইঞ্চি রেখে ওয়ালের সঙ্গে কলামের মতো মেলানো হয় ওই একই কারণে। অথচ বিমের গভীরতা প্রস্থের চেয়ে বিশ থেকে আশি ভাগ বেশি রাখা হয়। এমনি করে ওয়ালের সঙ্গে কলাম আর বিমকে মেলাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বিমের আকার কলামের সমান বা কলামের চেয়েও বড় করা হয়, যা ভূমিকম্পে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ভূমিকম্পের সময় পার্শ্বশক্তি বিমের মাধ্যমে কলামের ওপর কাজ করে। তাই বিম বেশি শক্তিশালী হলে এবং বিমের চেয়ে কলাম দুর্বল হলে কলাম সহজে বিধ্বস্ত হয়। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশে ভবন ডিজাইন করতে বিম দুর্বল করে ডিজাইন করতে হবে। কারণ বড় মাত্রার ভূমিকম্পে কলাম নয় বরং বিমের দুই প্রান্তে ফাটল ধরিয়ে হলেও (যা রিপেয়ার করা যায়) ভবন বিধ্বস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা হয়। এ জন্য বিমের থেকে কলামকে কমপক্ষে শতকরা বিশভাগ বেশি বক্রনীয় শক্তিসম্পন্ন করে ডিজাইন করতে হয় (বিএনবিসি-৯৩)।
৪. সনাতনী ইট :আরসিসি ফ্রেমের মধ্যে ক্লে মাটির ভারী ইট ব্যবহার করলে ভবনের ওজন অধিক পরিমাণে বেড়ে যায়। তাই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট পার্শ্বশক্তির মাত্রাও আনুপাতিক হারে বেড়ে যায় বলে ভবন বিধ্বস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তা ছাড়া সনাতনী ইট শুধু বালু-সিমেন্টের মর্টার দিয়ে গাঁথতে হয় বলে ভূমিকম্পে সহজে বিধ্বস্ত হয়। এ জন্য ভূমিকম্পপ্রবণ দেশে কম ওজনের হলেও ব্রিক বা ব্লক ব্যবহার করা ভালো, যাতে ভবনের ওজন অপেক্ষাকৃত কম হয় এবং ওয়াল তৈরিতে শুধু মর্টারই নয় সঙ্গে রড দিয়েও গেঁথে দেওয়া যায়।
১৮৯৭ সালের ১২ জুন ঘটা দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েকটির পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমাদের অবস্থা যেন হাইতির মতো না হয়ে চিলির মতো হয় তা ভাবা দরকার। হাইতি ও চিলির উদাহরণ মনে রেখে হলেও বাংলাদেশে যে কোনো কাঠামো নির্মাণে ভূমিকম্পের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখতে হবে। এ জন্য স্থাপনার মালিকের বাড়তি কিছু পয়সা খরচ করার সদিচ্ছা থাকতে হবে।

ড. মোঃ আলী আকবর মলি্লক :কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব
 

No comments

Powered by Blogger.