কালান্তরের কড়চা-আন্দোলন কেন বারবার ব্যর্থ আস্ফালনে পরিণত হচ্ছে? by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

এগারোই জুন সোমবার এই লেখাটা লিখতে বসেছি। আজ বাংলাদেশে বিএনপির বহু বিঘোষিত বিক্ষোভ প্রদর্শন ও জনসমাবেশ দিবস। ১২ জুন মঙ্গলবার সকালে আমার এ লেখাটি যখন পাঠকদের চোখে পড়বে, তখন তাঁরা জেনে যাবেন, বিএনপি তার সরকারবিরোধী আন্দোলনের কতটা সূচনা করতে পারছে, নাকি তা আবার ব্যর্থ আস্ফালনে পরিণত হয়েছে।


সাধারণত বিএনপি যেদিন হরতাল বা বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকে, তার আগের রাতেই কিছু বাস, গাড়ি পুড়িয়ে এবং নিরীহ বাস ড্রাইভার বা রিকশাওয়ালাকে পুড়িয়ে মেরে তাদের শক্তির আগাম মহড়া দেয়।
এবার সেই মহড়া দেখা যায়নি। এই লেখাটি শুরু করার সময় পর্যন্ত, অর্থাৎ ১১ জুন ঢাকার সময় দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকা বা দেশের অন্য কোথাও গোলযোগের খবর পাইনি। তবে বিকেলে যখন মিছিল-সমাবেশ হবে, তখন কিছু গোলযোগ হতেই পারে। সরকার বিএনপি অফিসের সামনে এ সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে জননিরাপত্তার জন্য কিছু কঠোর ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। তাতে মনে হয়, মফস্বলের কথা বলতে পারি না, তবে ঢাকায় কোনো বড় ধরনের গোলযোগ হবে না। হলে অন্য কথা।
১১ জুন সকালে (লন্ডন সময়) এক ঢাকাইয়া বন্ধুকে শহরের খবর জানার জন্য টেলিফোন করেছিলাম। তিনি শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু ঢাকাইয়া বাংলায় আমাকে বললেন, 'ছালায় (শালায়) হাঙ্গামা করার আদমি কই, সবাই তো ফাটকে বন্দি। ইট-পাটকেল মারার মানুষ ত ভাড়া করার ছুযোগ তারা পায় নাই।' তাঁর কথায় খুব একটা আশ্বস্ত হইনি। সরকারের দমননীতির মুখে বিএনপি এখন গর্তে লুকালেও জামায়াত গর্তে লুকায়নি। পালের গোদারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে জেলে থাকায় তাদের আন্দোলন করার শক্তি খর্ব হলেও খুন-জখম, জ্বালাও-পোড়াওয়ের দক্ষতা নষ্ট হয়নি। মনে হয়, আপাতত তারা যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি বদলাতে বাধ্য হয়েছে।
১০ জুন সরকারকে দেওয়া বিএনপির চরমপত্রের মেয়াদ শেষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিসহ দলটির আরো কিছু দাবি এই তারিখের মধ্যে মেনে নেওয়া না হলে তার পরই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার যুদ্ধের দামামা বাজানো হবে বলা হয়েছিল। তবে এ দামামা এবার জোরেশোরে বাজেনি। কারণ দামামা বাজানোর জন্য, গর্জন-সেনাপতি হিসেবে বিএনপির মির্জা ফখরুলসহ যে নেতারা খ্যাত তাঁরা এখন জেলে। এমনকি বাজখাঁই গলার অধিকারী সাকা চৌধুরীও জেলে। কিছুদিন জেলের ভাত খাওয়ার পর তাঁরও বিক্রম কমে এসেছে মনে হয়। তিনি জানিয়েছেন, তাঁকে বিচার চলাকালে জামিনে মুক্তি দিলে তিনি খালেদা জিয়া ও দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদ অধিবেশনে যোগ দেবেন (হায় রে খাঁচাবন্দি কেঁদো বাঘ!)।
সরকার বিরোধী দলের আলটিমেটাম বা চরমপত্র অগ্রাহ্য করেছে। একেবারে অগ্রাহ্য করত না, যদি তারা জানত বিএনপির আন্দোলন করার তাগদ আছে। গাড়ি পোড়ানো বা বাস ড্রাইভার, রিকশাচালক হত্যা তো আন্দোলন নয়। আন্দোলন হচ্ছে জনসমর্থনের জোরে সারা দেশ অচল করে দেওয়া। বিএনপি কোনো দিন তা পারেনি, কোনো দিন পারবে না। তারা যেটা পারে সেটা হচ্ছে, অসারের তর্জন-গর্জন। এই তর্জন-গর্জনে দলের নেত্রী থেকে শুরু করে পাতি নেতারা পর্যন্ত কতটা দড় তার প্রমাণ দেশের মানুষ বহুবার পেয়েছে।
এ সম্পর্কে আমার বন্ধু মোনায়েম সরকার একটি মজার কথা বলেন। তিনি বলেন, 'বিএনপি তো আন্দোলনের গ্রামারই (ব্যাকরণ) জানে না। তারা আন্দোলন করবে কি? ডোবায় জন্ম ব্যাঙাচি, বড়জোর ব্যাঙ হতে পারে। লাফ দিতে জানে, হাঁটতে জানে না। সেনা ছাউনিতে জন্ম বিএনপিরও আজ একই অবস্থা। আওয়ামী লীগকে অনুকরণ করে আন্দোলন করতে চায়। কিন্তু সেটা আন্দোলন হয় না। হয় ব্যর্থ আস্ফালন। বারবার এই ব্যর্থ আস্ফালনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আন্দোলন আর হচ্ছে না।
১১ জুনও তাই বড় কিছু হচ্ছে বা হবে, তা আমার মনে হয় না। বিকেলের দিকের সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল থেকে কিছু গোলযোগ হতে পারে, পুলিশের সঙ্গে লাঠালাঠি হতে পারে, তার বড় কিছু নয়। যেটা হবে, সমাবেশে দাঁড়িয়ে আবার বিএনপি নেত্রী ও অন্যান্য নেতার আস্ফালন। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে সামনের ৪০ বছরেও আর ক্ষমতায় আসতে না দেওয়ার হুমকি। আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে হরতালবিরোধী যে মনোভাব, তাতে বুদ্ধিমান হলে বিএনপি নেতারা আর হরতালের ডাক দেবেন না। দিলে নিজেদের নাক তাঁরা নিজেরাই কাটবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি কথা ভালোভাবেই বুঝে গেছেন, বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির পেছনে কোনো আন্তরিকতা নেই। এই দাবি নিয়ে তারা যে হৈচৈ করছে, তার মূল উদ্দেশ্য, নির্বাচনে তারা হেরে যাবে- এটা বুঝতে পারলে তাতে অংশগ্রহণ না করার একটা পথ খোলা রাখা। এ ব্যবস্থাকে বিএনপিই ইয়াজউদ্দিনের প্রেসিডেন্টগিরির আমলে এমন বর্জ্য জাতীয় ব্যবস্থায় পরিণত করে গেছে যে এটি এখন একটি পচা আম। দুর্গন্ধ ছাড়া এ ব্যবস্থায় এখন আর কিছু নেই। এই ব্যর্থ ও দূষিত ব্যবস্থাকে পুনর্বহাল করে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যাবে কি? ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। খালেদা জিয়া সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মানতে চেয়েছিলেন কি? এখন তিনি কোন মুখে বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে না?
বর্তমানে বিএনপির শত ডাকেও যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে না, তার বড় কারণ জনগণ এ ব্যবস্থার মাজেজা বুঝে গেছে। তারা আর পচা আমের খোসায় পা পিছলাতে রাজি নয়। তাই বিএনপি নেত্রীর এত আস্ফালন, সরকারকে আলটিমেটাম ইত্যাদি সত্ত্বেও এ দাবির পেছনে জনসমর্থন জড়ো করা যাচ্ছে না। দেশের মানুষ দেখতে চায় একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, তা যে ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হোক না কেন।
তথাপি আগামী নির্বাচনকে সব বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনের আগে এক ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারে। ১৯৪৬ সালে ভারত ভাগের আগে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ মিলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (Interim Government) গঠিত হয়েছিল, যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন কংগ্রেস থেকে নেহরু এবং মুসলিম লীগ থেকে অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন লিয়াকত আলী। অনুরূপভাবে বর্তমান বাংলাদেশে একটি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পারে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। খালেদা জিয়া ও জেনারেল এরশাদ ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হবেন। মহাজোট ও ১৮ দলীয় জোট থেকে অন্যান্য মন্ত্রী গ্রহণ করা হবে। সংসদের বাইরেই এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন নিয়ে সর্বদলীয় ভিত্তিতে আলোচনা হতে পারে। ঐকমত্যে পৌঁছলে তা সংসদে সর্বসম্মতভাবে পাস করালেই হবে। তবে আমার আশঙ্কা, আওয়ামী লীগ তার সব আন্তরিকতাসহ এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে এগোলেও বিএনপি তাতে সাড়া দেবে না। তাদের কথা 'সালিস মানি, তালগাছটা চাই।'
আমার অনেক বন্ধুর ধারণা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবির পেছনে যথেষ্ট জনসমর্থন আছে। আমার তা মনে হয় না। দেশের মিডিয়াগুলোর লেখালেখি বা টেলিভিশনের টক শো দেখে যাঁরা এ কথা ভাবেন, তাঁরা বৃহৎ পল্লীবাংলার নাড়ির স্পন্দন জানেন না। বিএনপির এ দাবিতে শহুরে মধ্যবিত্তদের বিলাসী সমর্থন রয়েছে। গ্রামের মানুষ এ ব্যবস্থা নিয়ে মাথা ঘামায় না। ১৯৯৬ সালে যে ঘামিয়েছিল তার কারণ পরিস্থিতির বাস্তবতা, আওয়ামী লীগের তৎকালীন জনপ্রিয়তা এবং আন্দোলন করার সক্ষমতা ও কৌশল জানা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কেন কেবল আমাদের এলিট শ্রেণীর অবসরের বিলাসী বিতর্ক তার একটা উদাহরণ দিই। সাবেক ব্যুরোক্র্যাট এবং ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্য আকবর আলি খান একজন ভালো মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীও। তিনি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থনে গলা মিলিয়েছেন, কিন্তু নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রভাবশালী সদস্য থাকাকালে কয়েকজন সহকর্মীসহ যে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন, তার কারণগুলো খোলাসা করে বলেন না কেন?
লেখাটা শুরু করেছিলাম বিএনপির সরকার হটাও আন্দোলন বা আস্ফালন নিয়ে। এ সম্পর্কে একটি মজার কথা বলে লেখাটা শেষ করতে চাই। বিএনপির নিরপেক্ষ নামে পরিচিত সমর্থক দৈনিকটি আজকাল হরতাল করার বদলে কিভাবে সফল আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে, সে সম্পর্কে গাইডলাইন দেওয়া শুরু করেছে। একটি উপসম্পাদকীয়তে জোরালো ভাষায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, হরতাল করে জনগণের মনে বিরক্তি উৎপাদন না করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কেন দলে দলে কারাবরণ করে দেশের সব জেল ভর্তি করে সরকারকে অচল করে দেয় না?
লেখাটি পড়ে খুব মজা পেয়েছি। মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ ও অহিংস আন্দোলনের ডাকে হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় কারাবরণ করে ব্রিটিশ-রাজের জেল ব্যবস্থা অচল করে দিত। আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশের বর্তমান বিএনপি কি গায়ে-গতরে ব্রিটিশ আমলের কংগ্রেস? খালেদা জিয়ার ডাকে কয়জন নেতা-কর্মী যাবেন জেলখানা ভর্তি করতে? বেগম সাহেবা, একবার ডাক দিয়ে দেখুন। দলের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সব অফিস খালি হয়ে যাবে। ব্যারিস্টার মওদুদ যে এখন মিহিমিহি সুরে তর্জন-গর্জন করছেন, তাঁকেও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
লন্ডন, ১১ জুন, সোমবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.