অগ্রগতি নির্ভর করছে বিদ্যুৎ খাতের সাফল্যের ওপর by ইফতেখার আহমেদ টিপু

বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে শহর-গ্রাম সর্বত্র গ্রাহকরা চরম হতাশ। গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভোগান্তিও বেড়েছে। শিল্প-কারখানার কারণে শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহে অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও দিনের অর্ধেক সময় নগরবাসীকে বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে। গ্রামের পরিস্থিতি আরো খারাপ।


ফলে তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে এমন কথায় মানুষ আর আশ্বস্ত হতে পারছে না।
গ্রীষ্মে রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রায় জনজীবন যখন অতিষ্ঠ, ঠিক তখনই সীমা অতিক্রম করতে চলেছে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া খেলা। চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎই কেবল এখন সরবরাহ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার কাছাকাছি হলেও গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষ যখন সিদ্ধ হওয়ার উপক্রম, তখনো এর একটা বড় অংশের উৎপাদন বন্ধ রাখা হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেশি- এ যুক্তিতে ফার্নেস অয়েলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাংশ বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎ ঘাটতিতে একদিকে যেমন শিল্প উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়ছে অন্যদিকে মানুষের স্বস্তি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সন্দেহ নেই, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে উত্তরাধিকার সূত্রে বিদ্যুৎ ঘাটতি মাথায় নিয়ে। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিশাল জয়ের পেছনে এ ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি যেভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনও এদিক থেকে ছিল সমর্থনযোগ্য। তবে দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা পূরণের জন্য সাশ্রয়ী প্রকল্প গ্রহণ না করে যেভাবে একের পর এক জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়, তা নিয়ে শুরুতেই বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তোলেন। এ মুহূর্তে যখন গ্রীষ্মের দাবদাহের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, ঠিক সে মুহূর্তে খরচ বাঁচানোর নামে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বড় অংশ বন্ধ রাখা দেশবাসীর সঙ্গে রসিকতার নামান্তর। প্রশ্ন হলো, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে যেসব ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে প্রয়োজনের মুহূর্তে সেগুলো যদি বন্ধ রাখা হয়, তবে তা তৈরি করা হয়েছিল কেন? এ কেন্দ্রগুলোর পেছনে যে অর্থের অপচয় হয়েছে তার দায় কার? আমি মনে করি, ভর গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ সরকারের কর্তব্য হওয়া উচিত।
তা ছাড়া দাম বেশি দিলে শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। তিনটি ভোল্টেজ লেভেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ১৩ টাকা ৮৮ পয়সা থেকে ১৪ টাকা ৯৯ পয়সা। আগামী ১ জুন থেকে কার্যকর হবে এ প্যাকেজ। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৩২ কেভি লাইনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে প্রতি ইউনিট ১৩ টাকা ৮৮ পয়সা দামে। বর্তমানে এর দাম পাঁচ টাকা ৩৩ পয়সা। ৩৩ কেভি লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ইউনিটপ্রতি দাম নেওয়া হবে ১৪ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে এর দাম পাঁচ টাকা ৬১ পয়সা। ১১ কেভি লাইনে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ টাকা ৯৯ পয়সা। যার বর্তমান দাম পাঁচ টাকা ৯০ পয়সা। শিল্প-প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্যাকেজ ঘোষণা ইতিবাচক হলেও গড়ে প্রায় তিনগুণ দামে বিদ্যুৎ নিয়ে কেউ শিল্প-প্রতিষ্ঠান চালাবেন কি না তা একটি প্রশ্নের বিষয়। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্টদের যে বাড়তি দাম দিতে হবে তাতে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে অনুকূল হবে কি না তাও একটি বিবেচ্য বিষয়। শিল্প মালিকরা বলেছেন, বিদ্যুতের দামের ক্ষেত্রে যে আকাশ-পাতাল বৈষম্য রাখা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এ ধরনের সুবিধা নেবেন তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বেশি পড়বে। এর ফলে প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে পড়তে হবে।
পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে এখন আর বিদ্যুৎ যায় না, কখনো কখনো আসে। বিদ্যুৎ গেলে কখন আসবে কিংবা এলে কতক্ষণ থাকবে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। মধ্যরাতে গভীর ঘুমের ভেতর গরমে ঘেমে নেয়ে উঠে দেখা যায় পুরো এলাকা ভুতুড়ে অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে। রাত নেই, দিন নেই নজিরবিহীন বিদ্যুৎ সংকটে কি শহর, কি গ্রামে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ নিয়ে মানুষের মধ্যে এখন ক্ষোভ, হতাশা বাড়ছে। বিদ্যুতের অভাবে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের কাজকর্ম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় এখন অঞ্চলভেদে প্রতিদিন প্রায় ছয় থেকে আটবার লোডশেডিং হচ্ছে। গভীর রাতেও লোডশেডিং হচ্ছে যখন তখন। যারা স্বাভাবিক বিদ্যুৎবিভ্রাট মোকাবিলায় নিজেদের বাসায় ও কর্মস্থলে আইপিএস লাগিয়েছেন, সেটাও লোডশেডিং সামাল দিতে পারছে না। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে আইপিএসও আর কাজ করছে না। যার ফলে লাঘব হচ্ছে না মানুষের দুর্ভোগ।
বিদ্যুতের সঙ্গে দেশের উন্নয়নই শুধু নয়, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের প্রশ্নও জড়িত। বাংলাদেশ কতটা এগিয়ে যাবে তা নির্ভর করছে এ খাতের সাফল্য ও ব্যর্থতার ওপর। সরকারের অস্তিত্বের সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের সাফল্য জড়িত থাকায় সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক হবে- আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকার এবারের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। সে অনুযায়ী বরাদ্দও রেখেছে। যথাযথভাবে উন্নয়ন কাজটি সম্পন্ন করতে পারলে বিদ্যুৎ সমস্যা অনেকাংশে দূর হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.

No comments

Powered by Blogger.