কালের পুরাণ-‘পতিত’ ও ‘অতীত’ শাসকের জবানবন্দি by সোহরাব হাসান

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। একজন সৈনিক থেকে রাজনীতিক, অপরজন শিক্ষক থেকে রাষ্ট্রপ্রধান। সম্প্রতি তাঁদের দুটি সাক্ষাৎকার জনমনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। পতিত সামরিক শাসক এরশাদ একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ১৯৮২ সালে তিনি ক্ষমতা দখল করেননি।


রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার স্বেচ্ছায় তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। ডাহা মিথ্যা কথা। সেই সময়ের কুশীলবেরা কেউ কেউ মারা গেলেও অনেকে বেঁচে আছেন।
আজ এরশাদ সাহেব আওয়ামী লীগের ওপর সওয়ার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলের দুই দিন পর ২৬ মার্চ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে কর্মকর্তাদের সমাবেশে কী বলেছিলেন, তাও অজানা নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা (সেনাবাহিনী) প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকব এবং তারপর রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করব। কিন্তু অনিবার্যভাবে আওয়ামী লীগের কাছে নয়। কেননা আওয়ামী লীগ সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেবে।’ (সূত্র: স্বৈরশাসনের নয় বছর ১৯৮২-৯০, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, ইউপিএল ১৯৯১)
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি কথা চালু আছে, আমেরিকা যার বন্ধু, তার শত্রুর প্রয়োজন হয় না। দেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, এরশাদ যার বন্ধু, তার শত্রুর দরকার হয় না।
অন্যদিকে অতীত শাসক ইয়াজউদ্দিন একটি দৈনিকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্বও পালন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চার উপদেষ্টার জন্য তা করতে পারেননি। একটি পক্ষের হয়ে তাঁরা কাজ করতে না পেরে পদত্যাগ করায় এক-এগারোর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি যাঁদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছেন, তাঁরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং সজ্জন বলেও পরিচিত। তাঁরা নিশ্চয়ই এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন অন্যখানে। এ মুহূর্তে এই দুই অতীত পতিত শাসক এ ধরনের সাক্ষাৎকার কেন দিলেন? আত্মরক্ষার জন্য? নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য? এরশাদ এ কাজটি বহুবার করেছেন, ক্ষমতায় থাকতে এবং ক্ষমতাচ্যুত হয়েও। এরশাদ এমন সময়ে সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন, যখন অবৈধ ক্ষমতা দখলের দায়ে তাঁর বিচারের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। এরশাদ বলেছেন, তিনি ক্ষমতা নিতে চাননি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার স্বেচ্ছায় তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। তাঁর এই দাবি যে সর্বৈব মিথ্যা, তা দেশের রাজনীতি-সচেতন নাগরিকমাত্রই জানেন। দেশবাসী সেদিন দেখেছেন, একদল সেনা কর্মকর্তা বঙ্গভবনে গিয়ে জোর করে ক্ষমতা দখল করেছেন। সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন ২৪ মার্চ ভোরে, আর বিচারপতি সাত্তার ভাষণ দেন ওই দিন সন্ধ্যায়। বন্দুকের মুখে তাঁকে বাধ্য করা হয়। এরশাদ বিচারপতি সাত্তার সরকারের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি ও অপশাসনের অভিযোগ এনেছেন। আবার তাঁর মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্যদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়েছেন। পুরোটাই ছিল ভন্ডামি।
এরশাদ যেভাবে নিজের ক্ষমতা দখলের পক্ষে সাফাই গাইছেন, সেই কাজটি তাঁর পূর্বসূরিরাও করেছেন। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জা আইয়ুব খানের হাতে এবং ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন বলে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছিল। পরবর্তীকালে তথ্য-প্রমাণে বেরিয়ে আসে, তাঁরা কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি, পদত্যাগ করানো হয়েছে। ১৯৬৯ সালে আইয়ুবের এবং ১৯৯০ সালে এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের পটভূমি সবার জানা।
১৯৮২ সালের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও রাজনৈতিক কুশীলবেরা এখনো প্রায় সবাই বেঁচে আছেন। তাই আবোলতাবোল বলে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।
এটিএন নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এরশাদ দাবি করেছেন, ১৯৮৪ সালে নাকি তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেনাবাহিনীর প্রধানের পদে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত তিনি দল করেননি। তাঁর এ দাবিও অসত্য ও ভিত্তিহীন। তখন জাতীয় পার্টি গঠিত না হলেও এরশাদ বিচারপতি আহসানউদ্দিনকে দিয়ে জাগো দল করেছিলেন। পরে জাগো দল ও রাষ্ট্রপতির পদ থেকে আহসানউদ্দিনকে সরিয়েও দিয়েছিলেন। বিভিন্ন দল থেকে নিন্দিত ও সুবিধাভোগী নেতাদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। এরশাদ ১৯৮৪-৮৫ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে চেয়েছিলেন সত্য; তবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নয়, ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে। রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারব্যবস্থায় সংসদের ক্ষমতা সীমিত। রাষ্ট্রপতিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। জিয়া ও এরশাদ দুজনই বিষয়টি বুঝেছিলেন। রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দিতে পারেন এবং ১৯৮৭ সালে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে তা ভেঙেও দিয়েছিলেন।
ওই সাক্ষাৎকারে এরশাদ তাঁর কবিতা লেখা থেকে শুরু করে প্রেম-বিয়ে সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছেন। সেগুলো তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার, রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু তাঁরই দুই প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও মিজানুর রহমান চৌধুরী তাঁদের স্মৃতিকথায় এরশাদের শাসনামলের অনেক অজানা তথ্য দিয়েছেন। তিনি যখন খুশি কাউকে মন্ত্রী বানাতেন, আবার আমের খোসার মতো ছুড়ে ফেলে দিতেন। ক্ষমতায় থাকার জন্য এমন কোনো কূটবুদ্ধি নেই, যা এরশাদ ব্যবহার করেননি। তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি, বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করেছেন। তিনি বিএনপির কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ায় বিএনপি বেশি ক্ষুব্ধ ছিল। আবার আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে জন্য তিনি সেনাবাহিনীর মধ্যে ভীতিও ছড়িয়েছিলেন।
১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় কবিতা উৎসবের অনুষ্ঠানে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে শিল্পী কামরুল হাসান মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি এরশাদকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন ‘বিশ্ববেহায়া’ নামে। সেই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর গাড়িতেই শিল্পীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরদিন শোক বিবৃতি দেওয়ার জন্য মিজানুর রহমান চৌধুরীকে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারাতে হয়। এই বরেণ্য শিল্পী সম্পর্কে এরশাদ কী বলেছিলেন, তা শোনা যাক মিজানুর রহমান চৌধুরীর বয়ানে, ‘পত্রিকায় এই ব্যঙ্গচিত্র ও শোকবাণী দেখে এরশাদ মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ সভা ডাকেন। সেখানে তিনি তীব্র উষ্মা প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে এরশাদ বলে ফেলেন, “এই শিল্পী একজন কমিউনিস্ট, নাস্তিক। এই ক্যালিভারের শিল্পীরা প্যারিসের রাস্তায় ছবি এঁকে ভিক্ষা করে।’ (রাজনীতির তিন কাল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, অনন্যা)
কেবল তা-ই নয়, এই স্বৈরশাসক ক্ষমতায় থাকতে শহীদ মিনারকেও অপমান করেছেন, সেখানে শহীদদের সম্মানে ফুল দেওয়াকে ‘বেদাত কাজ’ বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন।
সাক্ষাৎকারে এরশাদ তাঁর বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করেছেন। বলেছেন, ‘নূর হোসেন এমন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি ছিল না যে তাকে আমি হত্যা করব। তাকে পুলিশ গুলি করেছে, না নিজেদের লোকেরা গুলি করেছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন সাবেক এই স্বৈরশাসক। নূর হোসেন যুবলীগের কর্মী ছিলেন। এরশাদের প্রশ্নের জবাব আওয়ামী লীগের নেতারাই ভালো দিতে পারবেন। বিএনপি আমলে প্রকাশিত রিন্টুর বই নিয়ে ব্যাপক হইচই হয়েছে। এরশাদের বক্তব্য রিন্টুর বইয়ের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়।
ডা. শামসুল আলম মিলন সম্পর্কে তাঁর দাবি, তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন না। মেডিকেল কলেজ থেকে পিজি হাসপাতালে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তাঁকে গুলি করেছে এরশাদের লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডাবাহিনী। স্বৈরশাসকেরা পুলিশ, বিডিআর, সেনা নামিয়েও যখন আন্দোলন দমন করতে পারে না, তখনি গুন্ডা বাহিনী নামায়। আইয়ুব থেকে এরশাদ—সবাই এই অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। এরশাদের অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন ছাত্রনেতা রউফুন বসুনিয়া, রাজু, সেলিম, দেলোয়ার, শাহজাহান সিরাজ, শ্রমিকনেতা তাজুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের নেতা ময়জুদ্দিন প্রমুখ। এর বাইরে অসংখ্য সাধারণ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন। এখনো মহানগরের যেকোনো এলাকায় দু-একটি স্মৃতিসৌধ পাওয়া যাবে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের শহীদদের। হাতিরপুল বাজারের দেলোয়ার হোসেন দিলু গরিব হোটেল কর্মচারী, যিনি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সময় কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নেমেছিলেন বলে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিংবা তিরাশির ছাত্রমিছিলে নিহত জয়নাল, দীপালিও পরিচিত কেউ ছিলেন না। প্রকৃত প্রস্তাবে অজ্ঞাত ও অখ্যাত ব্যক্তিরাই জীবন দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল করেন, নেতাদের ক্ষমতায় বসান। হাতিরপুল বাজারে নবনির্মিত দিলুর স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেছেন স্থানীয় সাংসদ ফজলে নূর তাপস। আর সেই সংসদেই আওয়ামী লীগে শরিক হলো এরশাদের জাতীয় পার্টি। যে দেশে ঘাতক ও শহীদের দল ঐক্যবদ্ধ হয়, সেই দেশে গণতন্ত্র টেকসই হতে পারে না।
১৯৮৬ সালে এরশাদ বিজয়ের মুলা দেখিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীদের নির্বাচনে নিয়ে যে আছাড়টি মেরেছিলেন, আমাদের বিশ্বাস, আওয়ামী লীগের নেতারা তা এখনো ভুলতে পারেননি। তাঁদের সামান্য ভুলে খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী হয়ে যান।
অবৈধ ক্ষমতা দখলের জন্য এরশাদের বিচার হবে কি না, তা নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছা ও শহীদদের আত্মদানের প্রতি অঙ্গীকারের ওপর। কিন্তু আদালত ও দেশের জনগণ অনেক আগেই তাঁর বিচার করেছেন।
এবার অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সাক্ষাৎকার নিয়ে আরও দু-একটি কথা বলা প্রয়োজন। তিনিও দাবি করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেননি। এখানে তাঁর ভাষ্য তুলে ধরছি, ‘আমার উপদেষ্টা পরিষদ থেকে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে এটা আমার জন্য সুখবর ছিল না। তারা পদত্যাগ না করলে অন্যরকম হতে পারতো। আমাকে সহযোগিতা না করে তারা তাদের মতো করে চালাতে চেয়েছিল। তারা একটি পক্ষের সুবিধা দেখতে চেয়েছিলেন এবং সেভাবেই কাজ করেছিলেন। যখন পারছিলেন না তখন তারা পদত্যাগ করেন।’ (মানবজমিন, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০)
এই সাক্ষাৎকারেও ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজের সাফাই গেয়েছেন। ভুল স্বীকার করেননি। যদিও তিনি বলেছেন, একটি পক্ষের রাজনীতি করতেন এবং সেই দলের কল্যাণেই তিনি দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছিলেন।
আমরা এরশাদ ও ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে এক কাতারে ফেলতে চাই না। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ শুধু রাজনীতি না করলেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তীকালে সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীনে উপদেষ্টা হয়েছিলেন। বিএনপির আমলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করেছিলেন। এক জীবনে আর কত চাই? তিনি রাষ্ট্রপতির পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন। কেন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলেন, সেটি রহস্যই রয়ে গেল? যে আইনের দোহাই দিয়ে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলেন, সেই আইনে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির কথাও ছিল। ১৫ কোটি মানুষের দেশে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যেত। কেন তিনি সেই চেষ্টা করলেন না?
ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এক-এগারোর পরবর্তী জরুরি অবস্থা জারি ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। তবে সবটা বলেননি, বই লিখেছেন, প্রকাশিত হলে পাঠক জানতে পারবেন বলে মন্তব্য করেছেন। আমরা বুঝি না, তাঁর মতো একজন প্রবীণ শিক্ষকের সত্য বলতে এত ভয় কেন? তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, জরুরি অবস্থা জারি না করলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো এবং তাতে তিনি মরেও যেতে পারতেন। অর্থাৎ তিনি আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করেছিলেন। দুটি সামরিক অভ্যুত্থানে দেশের দুজন রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন। তিনি সেই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি চাননি—ভালো কথা। কিন্তু তিনি চাইলে এক-এগারোর পরিস্থিতি এড়াতে পারতেন, জরুরি আইন জারির প্রয়োজন হতো না। তিনি সেই পথে গেলেন না কেন? তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগও একপর্যায়ে তাঁর প্রতি আস্থা এনেছিল। বঙ্গভবনে গিয়ে বৈঠক করে নেতারা বলেছিলেন, ‘আপনি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করুন। আমরা সহযোগিতা করব।’ আওয়ামী লীগের দাবি ছিল, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন সাহেব এর কোনোটা না করে বিএনপির ছক অনুযায়ী ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেন। এ অবস্থায় দেশ সংঘাতমুখর হয়ে ওঠে। অতএব এর দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
তবে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এই সাক্ষাৎকারে তাঁর অসহায়ত্বের কথাও বলেছেন। তিন বাহিনীর প্রধানেরা যখন জরুরি অবস্থা জারির জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, তখন তিনি সময় চেয়েছিলেন। স্ত্রীর কাছে টেলিফোন করার সুযোগও তাঁরা দেননি বলে আক্ষেপ করেছেন। এ অবস্থায় তাঁর দুটি বিকল্প ছিল, সৎসাহস নিয়ে পদত্যাগ করা, অথবা সেনা কর্মকর্তাদের হুকুম তামিল করা। তিনি দ্বিতীয় পথই বেছে নিলেন। দেশ সাহসী শিক্ষক পেল না। পেল বশংবদ একজন রাষ্ট্রপতি।
দুটি সাক্ষাৎকারেই আত্মপক্ষ সমর্থন বা সাফাইয়ের চেষ্টা আছে। কিন্তু ঘটনাগুলো এত কাছাকাছি এবং প্রকাশ্যে ঘটেছে যে রাতকে দিন করা যায় না। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দুই নেত্রীর প্রশংসা করেছেন, মাইনাস টু ফর্মুলা সম্পর্কে কিছু জানতেন না বলে জানিয়েছেন। তাঁর এই বক্তব্য পাপ স্খলনের চেষ্টা, না অন্য কিছু? তার পরও ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সাক্ষাৎকারে যে অনুশোচনা ও আক্ষেপের সুর রয়েছে, এরশাদের সাক্ষাৎকারে তা নেই। তিনি এখনো নয় বছরের স্বৈরশাসনের পক্ষে সাফাই গাইছেন। হয়তো যত দিন বেঁচে থাকবেন, তা-ই করবেন। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে ক্ষমা করবে না।
আমরা অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাই না। এক ‘অতীত’ এবং আরেক ‘পতিত’ শাসকের স্বীকারোক্তি কিংবা সাফাই জাতির কোনো উপকারে আসবে না, যদি আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি না বদলায়। তাঁদের ব্যর্থতার চোরা গলি দিয়েই এরশাদ, ইয়াজউদ্দিন ও মইন উরা মসনদে আরোহণ করে দেশ ও জনগণের সর্বনাশ করেছেন।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.