তরুণ প্রজন্ম-ইংরেজি-দক্ষতা ও আমাদের করণীয় by আবেদ চৌধুরী ও মুনির হাসান

বিদেশে কর্মসংস্থান এখন আমাদের অর্থনীতির একটি শক্ত খুঁটি। সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা আসে এর মাধ্যমে। দেশের যাঁরা নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণ করেন—দুবাই, সিঙ্গাপুর, মরিশাস প্রভৃতি জায়গায়—তাঁদের সবারই চোখে পড়ে বিমানে আরোহণরত বাংলাদেশি শ্রমিক ভাইদের। তাঁদের পরিশ্রমে নির্মিত হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির শক্ত বুনিয়াদ।


ম্যানিলা থেকে কোপেনহেগেন, সিডনি থেকে সিয়াটল—বাংলাদেশের কর্মীদের উদ্যমে মুখরিত। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই জনবলকে বিদেশে পাঠানোর আগে তাঁদের আমরা কতখানি শিক্ষায় বলীয়ান করতে পেরেছি।
সিঙ্গাপুর থেকে মরিশাস বা ঢাকা থেকে দুবাই যেতে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি, আমাদের শ্রমিক ভাইদের অনেকেই ইমিগ্রেশন ফরম পূরণে অপারগ। এমনকি তাঁদের মধ্যে অনেকে বোর্ডিং পাসও পড়তে পারছেন না। বিমানের ভেতর দীর্ঘ লাইন দিয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন অপরের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে। অন্য দেশের যাত্রীরা তাঁদের নিয়ে হাসাহাসি করে। এ রকম একটি ফ্লাইটে একজন বিদেশি আমাদের একজনকে উপযাচক হয়ে কিছু উপদেশও দিলেন। তখন তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো যে এ অবস্থার কথা দেশের শিক্ষামন্ত্রীকে জানানো হবে।
তবে আমাদের শিক্ষামন্ত্রীকে বিষয়টি জানাতে হয়নি। গত ৭ আগস্ট বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির আয়োজনে হয়ে যাওয়া গণিত শিক্ষাবিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে খোদ শিক্ষামন্ত্রী এ নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন (গোলটেবিলের বিস্তারিত ছাপা হয়েছে ২২ আগস্টের প্রথম আলোয়)। দেশ-বিদেশে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক যে পাঠাচ্ছে, তার কি কর্তব্য নয় এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করা, যাতে প্রত্যেক শ্রমিক অন্তত বোর্ডিং পাসটা পড়তে পারেন। এসএসসি পরীক্ষার সময় ইমিগ্রেশন ফরম পূরণ করার যোগ্যতা মাপা দরকার, মনে হয়।
তবে শুধু বিদেশগামী শ্রমিক নন, সর্বস্তরের এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গড় ইংরেজি-দক্ষতা সন্তোষজনক নয়। দীর্ঘ ১২-১৪ বছর ক্রমাগত ইংরেজি শেখার পরও তাদের ইংরেজি জ্ঞানের অভাব দেখে বিস্মিত হতে হয়। মাঝেমধ্যে অবাক লাগে, কীভাবে একের পর এক পরীক্ষা তাঁরা পাস করে গেছেন অথচ ন্যূনতম কথাবার্তা ইংরেজিতে চালানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই। সাধারণ শব্দের বানানও তাঁরা শেখেননি! এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় বিপর্যয়ের চিহ্ন।
বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে আমরা যে সম্ভাবনার অপমৃত্যু দেখছি ইংরেজি-দক্ষতার অভাবে, সেটিরই দেশীয় সংস্করণ এখন আমরা দেখতে শুরু করেছি। তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশের ফলে বাংলাদেশেও আউটসোর্সিং, কল সেন্টার ইত্যাদির বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। কারিগরি দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও শুধু প্রায়োগিক ইংরেজি জ্ঞানের অভাবে এই সম্ভাবনা শেষ পর্যন্ত অধরা থেকে যেতে পারে। গত ২৫ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে (সাড়ে ৪০০ কল সেন্টার কাজই শুরু করতে পারেনি) বলা হয়েছে, ইংরেজি জানা জনবলের অভাবে লাইসেন্স পাওয়া ৪৮৯টি কল সেন্টারের মধ্যে ৪৫৬টি কাজ করতে পারছে না। প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘কল সেন্টারের মূল পুঁজি ইংরেজি ভাষায় অনর্গল দক্ষতা, যা বাংলাদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। এই দক্ষতা তৈরি হলেই আমেরিকা-ইউরোপের চেয়ে ১০ ভাগ সস্তায় দেশে জনবল পাওয়া সম্ভব হবে। তবে আমাদের ধারণা, ইংরেজিতে যোগাযোগের দক্ষতার অভাবে বর্তমানে যে তরুণ প্রজন্ম স্বাধীন আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের অনেকে যোগ্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হন।
শিক্ষাব্যবস্থার এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এমনটি বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী ওই গোলটেবিল বৈঠকে। আমরা জেনেছি, ২০০৯ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষার মানের দুর্বলতার কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত কমিটি মাসখানেক আগে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে একই সময়ে গঠিত গণিতবিষয়ক কমিটির খসড়া প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলেও ইংরেজিবিষয়ক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়নি। আমরা আশা করি, সেই প্রতিবেদনে সংকট উত্তরণে নিশ্চয় দিকনির্দেশনা ও সুপারিশ করা হয়েছে, যা সরকার গ্রহণ করবে।
তবে এটি অনস্বীকার্য যে প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই এটি সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। এ জন্য পর্যাপ্ত সময় ও শ্রম দিতে হবে। তাড়াহুড়ো করে পরিবর্তন করলে তা থেকে ভালো কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।
তবে শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারিয়ে তার থেকে কার্যকর সুফল পাওয়ার জন্য আমাদের কিছু সময়ের প্রয়োজন। এ সময় আমাদের বর্তমান প্রজন্মের ইংরেজি-দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রম নেওয়া দরকার। একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় এবং এলাকাভিত্তিক ইংরেজি ক্লাব বা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী এবং বিদেশে গমনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ইংরেজি শেখার একটি প্লাটফরম গড়ে উঠবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কমিউনিকেটিভ ইংরেজি কোর্স চালু করা যেতে পারে। যে যে বিষয়ে পড়ুক না কেন, তাকে ইংরেজি ভাষায় কিছু দক্ষ হতেই হবে। স্কুল-কলেজে ইংরেজি বিতর্কের চল বাড়ানো, গণিত অলিম্পিয়াড বা ভাষা প্রতিযোগের মতো ইংরেজি ভাষার কোনো প্রতিযোগিতার আয়োজন, আমেরিকা বা যুক্তরাজ্যের মতো আমাদের দেশেও ইংরেজি বানানের স্পেলিং বি-এর মতো প্রতিযোগিতার আয়োজনের প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে।
বিদেশগামীদের ইংরেজি শিক্ষায় এবং মধ্যপ্রাচ্যগামীদের বেলায় আরবি শিক্ষার ব্যাপারটি যাতে ঠিকভাবে নজর দেওয়া হয়, এর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের শ্রমিকদের অনেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে পাড়ি দেন। তার একটি ক্ষুদ্র অংশের বিনিময়ে যাতে তিনি কাজ চালানোর মতো বিদেশি ভাষা শিখতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব এজেন্সি উদ্যোগ নেবে, তাদের জন্য সরকার বিশেষ প্রণোদনা-সুবিধা দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে।
আমাদের তরুণদের একটি বিশেষ অংশ এরই মধ্যে মুঠোফোন, ইন্টারনেট ও ফেসবুকে অভ্যস্ত হয়েছে। তাদের এই প্রযুক্তির মাধ্যমেও ইংরেজি শেখার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা দরকার। একটিমাত্র বিবিসি জানালা বড়ই অপ্রতুল।
ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি আর একই সঙ্গে পুরোনো সম্পর্কের বিস্তার ঘটিয়ে ইংরেজি জানা জনগোষ্ঠী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে। এ যদি আমরা বুঝি বুঝলাম, না বুঝলে আমাদের নিজেদেরই ক্ষতি।
আবেদ চৌধুরী: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কর্মরত জিন-বিজ্ঞানী
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।

No comments

Powered by Blogger.